অ্যাডভোকেট সাহেব - Emperor's Empire
SUBTOTAL :
অ্যাডভোকেট সাহেব

অ্যাডভোকেট সাহেব

Short Description:

Product Description

কেদারায় ভ্রমণ



অ্যাডভোকেট সাহেব



আমি হলাম রাফি। পুরো নাম; রাফি আল মাহমুদ। বয়স তেইশ বছরের কাছাকাছি। কিছু মাস হলো যশোরের বাড়ি ছেড়ে ঢাকা শহরে আসার।
আমার ঢাকায় আসার গল্প ছিল কিছু এইরকম;


এসে গুলিস্থান থেকে আরেকটি বাস ধরে সোজা গেলাম নদীর ওপার কেরানীগঞ্জ মডেল টাউন নামের স্থানে। এখনও মনে আছে, সেদিন বাসের মধ্যে দুজন বেশ শিক্ষিত যুবক যাচ্ছিল আমার ঠিক সামনের সিটে বসে। সেই দুজন কোন এক সিনেমা দেখার জন্য নাকি টিকেট কিনে আনল। তাদের মধ্যে একজন টিকেট নিয়ে টানাটানি করাতে আরেকজন চিৎকার করে উঠেছিল, "এমন করিস না তো! ছিড়ে গেলে ছয় শত টাকা পানিতে।" এই কথাটা শোনার পর এই শহরের জীবনযাত্রার মান সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা হয়ে গেল। আমি সেই বাসের সিটে বসে হিসাব নিকাশে লেগে পড়লাম। মা আগেই বলেছিল, ঢাকা কিন্তু যশোরের মতো না। তাও আমি কোনোভাবেই বুঝতে পারছিলাম না, কীভাবে করে কেউ ছয় শত টাকা দিয়ে একটা চলচ্চিত্র দেখতে যায়। অদ্ভুত ব্যাপার লাগল আমার কাছে! বেশ অদ্ভুত! এই হিসাব নিকাশ করতে করতে পৌঁছে গেলাম কেরানীগঞ্জ।


বাড়ির ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে মাথায় সেই একই হিসাব নিকাশ চলছিল। সেই এলাকার এক মুদি দোকানিকে অ্যাডভোকেট সাহেবের বাসার ঠিকানা জিজ্ঞাস করাতে চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে, স্পষ্টভাবে পথ দেখিয়ে দিল। আমি সেই অনুযায়ী চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম সেই ঠিকানায়। বাড়ির দরজায় ঠকঠক করায় একজন বেশ বৃদ্ধ লোক দরজা খুললেন। উনার চেহারা দেখে বয়স প্রায় সত্তর-পঁচাত্তর মনে হচ্ছিল। লোকটা আমার দিকে কিছুক্ষণ ভাল করে তাকিয়ে বললেন, "যশোর থেকে এসেছেন নাকি?"
"হ্যাঁ।"
“নাম কি?"
"জি, রাফি।"
"হুম! ভেতরে আসো।"
আমি ভেতরে প্রবেশ করার সাথে সাথে আমার কাঁধের ব্যাগটা রেখে, জুতো জোড়া খুলে, জুতোর তাকের উপর রাখার সময় কিছু অদ্ভুত খেয়াল করলাম। এত বিশাল বাড়ির মালিক হবার পরও তাকের মধ্যে অ্যাডভোকেট সাহেবের একটা জুতোও দেখতে পারছিলাম না। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ সেখানেই তাকিয়ে ছিলাম। আমার এইভাবে মূর্তির মতো দাড়িয়ে থাকা অবস্থা দেখে সেই বৃদ্ধ লোকটা খিটখিটে স্বরে বললেন, "কি হলো? এভাবে হা করে কি দেখছ?" আমি চমকে উঠলাম এবং তৎকালীন সময়ে উত্তর স্বরূপ বললাম, "জি, কিছু না।" তারপর একটু সামান্য নীরবতার পর জিজ্ঞাস করলাম, "আচ্ছা, অ্যাডভোকেট সাহেব কি বাসায় নেই?"
বৃদ্ধ লোকটি আমার প্রশ্নটা শুনে কেমন বিস্মিত হয়ে আমার চেহারার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলেন, "তুমি কি সেই খালি জুতোর তাক দেখে এই প্রশ্নটা করেছ, বাবা?" লোকটার কথার মধ্যে কেমন এক আজব ভাবভঙ্গি লক্ষ করলাম। প্রশ্নটা করা বোধহয় আমার অপরাধ হয়েছে। তবুও জানার কৌতুহোলের কারণে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললাম, "জি!"



বৃদ্ধ লোকটা এক মুচকি হাসি দিয়ে চুপচাপ বাসার ভেতরের দিকে হাঁটা শুরু করলেন। আমি এই আচরণটা দেখে খুবই অবাক হলাম। কিন্তু কোন কিছু না বলেই উনার পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগলাম। বাসাটা বাহির থেকেই এত বিশাল, ভেতর দিয়ে তো আরো বিশাল জায়গা রয়েছে। এখানে প্রতিদিন কমপক্ষে দশ বার হাঁটাহাটি করলেও একজন ডায়াবেটিস রোগীর আর কোনো চিন্তাই থাকবে না। তবে জমিনের দিকে তাকালে দেখতে পাই খুবই লম্বা লম্বা দুটো রেখা যা পরস্পরের চেয়ে সমান রয়েছে। দাগগুলো দেখতে অনেকটা সাইকেলের চাকার দাগের মতো। কিন্তু প্রশ্নের বিষয় হলো, বাসার ভিতরে দুটো সাইকেল কে চালাবে?
এই কথা চিন্তা করতেই না করতে এসে হাজির হলাম অ্যাডভোকেট সাহেবের সামনে, আর উনাকে দেখার পরে আমার মনে তৎকালীন জাগ্রত সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম।


অ্যাডভোকেট সাহেব দুটো হাত দুপাশে ছড়িয়ে, রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে রয়েছেন। উনি বসেছিলেন একটি হুইলচেয়ারে। উনার পা এর দিকে তাকিয়ে অনুমান করলাম, এটা নিশ্চয়ই কোনো দুর্ঘটনার ফল। কেননা জন্মগত পা না থাকা লোকের পায়ের গঠন কিছুটা ভিন্ন হয়। রুমে প্রবেশ করার আগেই অ্যাডভোকেট সাহেব আমাদেরকে হাত দিয়ে ইশারা করে, থেমে যেতে বললেন। তারপর সেই বৃদ্ধ লোককে উদ্দেশ্য করে আরেকটি অদ্ভুত ইশারা করলেন। ইশারা দেখে খুবই অবাক হলাম, কিন্তু কিছু জিজ্ঞাস করার সাহস পেলাম না। ইশারা পেয়ে, কোনো কথা না বলেই, চুপচাপ সেই বৃদ্ধ লোকটা আমাকে নিয়ে গেল বাথরুমের কাছে। সেখানে আমাকে বললেন, "তুমি মাত্র এত বড় একটা সফর কেটে এসেছ, তাই উকিলবাবু তোমার সঙ্গে এই অবস্থায় দেখা করবে না। উনি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করেন। তাই তোমাকে আগে গোসল করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে হবে।" এটা শোনার পর কিছুক্ষণ অবাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। অতঃপর উনি জিজ্ঞাস করলেন, "কি হলো বাবা? কি চিন্তা করছ? বুঝতে পারনি আমার কথা?" আমি সাথেসাথে নাবোধকভাবে মাথা নাড়িয়ে বললাম, "না! বুঝতে পেরেছি।" এরপর গোসল করে, কিছুক্ষণের মধ্যে অ্যাডভোকেট সাহেবের সামনে উপস্থিত হলাম।

উনার রুমের বাহির থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম, উনি একটা পুরাণ আমলের সাদাকালো চলচ্চিত্র দেখছেন। ছবির মান দেখে তো মনে হচ্ছিল, সিনেমাটির বয়স প্রায় সত্তর বছর তো হবেই। অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব ইশারা করে আমাকে কাছে ডাকলেন। কাছে যাওয়াতে আবার ইশারা করে আমাকে উনার বাম পাশের সোফায় বসতে বললেন। সোফাটা দেখতে সামান্য সোফার মতো হলেও, বসার সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছিল আমি বাতাসের উপর বসে আছি। সোফাটার দামও নিশ্চয়ই তেমন মোটা অংকেরই হবে। অ্যাডভোকেট সাহেব ইশারা করে কাছে তো ডাকলেন ঠিকই, কিন্তু চুপচাপ টেলিভিশনের বিশাল পর্দার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। উনি এখন পর্যন্ত আমার চেহারা দেখেছেন কি না, সন্দেহ।


অবশ্য, আমরা উভয়ই একে অপরের চেহারা দেখেছিলাম ছবির মাধ্যমে। ছবিতে অ্যাডভোকেট সাহেবের দেহের উপরিভাগটুকুই দেখা যাচ্ছিল, তাই কল্পনাও করতে পারিনি এমন কিছু দেখব। উনি তৎকালীন যে সিনেমাটা দেখছিলেন, সেটার মধ্যে খুবই অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিলাম। সেখানে দেখলাম; একজন অত্যন্ত লম্বা ব্যক্তি খুবই আজব ভঙ্গিতে হাঁটছিল আর সেটা দেখতে আশেপাশের সবাই আতঙ্কে পালাচ্ছিল। সেখানে আরও দেখলাম; একজন চিকন মহিলা, দেখতে খুবই উদ্ভট, চুল উঁচু করে দাঁড়া করানো, সেই চুলের দুই পাশের দুটো অংশ সাদা। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ হাস্যকর মনে হলো বলে মুখ থেকে অল্প একটু হাসি বেড়িয়ে গেল। সেই মুহূর্তে নিজেকে থামাতে পারিনি। তবে মুখে চাপ দিয়ে হাসি থামানোর চেষ্টা করেছিলাম ঠিকই।


সিনেমা দেখা শেষ হবার পর টেলিভিশন বন্ধ করে আমাকে ইশারা করে দাঁড়াতে বললেন। আমি চুপচাপ দাড়িয়ে রয়ে গেলাম। অতঃপর একটু কাশি দিয়ে, গলা পরিষ্কার করাতে এই প্রথম উনার কন্ঠ শুনতে পেলাম। কি স্বর ছিল সেই কন্ঠের! সেই একটুকু শুনেই সিংহের গর্জনের কথা মনে পড়ে গেল। বাবা আসার আগেই বলেছিল উনার তুখোড় কণ্ঠস্বরের ব্যাপারে। বলেছিলেন, "অ্যাডভোকেট সাহেব যখন বিতর্কে নামেন, তখন যুক্তিও কান পেতে শুনে। আর উনার দক্ষতা এতটাই, যে চাঁদও যদি সূর্যের বিরুদ্ধে চুরি করা আলোর দাবি করে আদালতে মামলা করে, আর সেই মামলা যদি অ্যাডভোকেট সাহেব লড়েন, তাহলে সেই মামলাও অ্যাডভোকেট সাহেব মূহুর্তের মধ্যে জিতে যাবেন আর  সূর্য নিজের আলো চাঁদকে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হবে।"


বাবার কথাগুলো তখন তো বেশ হাস্যকর মনে হচ্ছিল, কিন্তু আজ সেই কথাগুলোই সত্য বলে মনে হচ্ছে। অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে প্রায় দশ মিনিটের মতো সেখানে দাঁড়া করিয়ে রাখাতে আমি আর সহ্য করতে না পেরে, হঠাৎ জিজ্ঞাস করে বসলাম, "অ্যাডভোকেট সাহেব, সারাদিন কি এভাবেই দাড়িয়ে থাকবো?" আমার প্রশ্নটি শুনে, মুখে এক মুচকি হাসির সঙ্গে বললেন, "খুবই অবাক করার মতো বিষয়, তাই না? কেউ দশ মিনিটও দাড়িয়ে থাকা সহ্য করতে পারে না, আর কেউ দশ বছরেরও বেশি সময় যাবত বসেই আছে। আমারও একসময় এই দাড়িয়ে থাকাটা বেশ বিরক্তিকর লাগত, কিন্তু এখন সেই বিরক্তি যেমন এক চাহিদায় পরিণত হয়েছে। উনার এই কথাগুলো শুনে, পুরোপুরিই নীরব হয়ে গিয়েছিলাম।
কিছু সেকেন্ডের সামান্য বিরতির পর হঠাৎ একজন কবির মতো করে, কবিতা আবৃত্তি শুরু করে বলতে লাগলেন, "অদ্ভুত এই অনুভূতি, অদ্ভুত এই বিরক্তি, অদ্ভুত এই জগৎ!
অদ্ভুত নদ-নদী, অদ্ভুত এই মানবজাতি, অদ্ভুত পাহাড় পর্বত।"


সেই লাইনগুলি অন্য কেউ আবৃত্তি করে থাকলে এতো মর্মান্তিক অনুভূতি কখনওই অনুভব করতে পারতাম না। শুধু উনি বলেই; সেই কন্ঠের ভার, সেই বলার রাজকীয় ভঙ্গি, সেই নিখুঁত উপস্থাপনা। এ সকল কিছুর একটির উপস্থিতিও না থাকলে, খুব একটা আবেগাপ্লুত হতাম না, কিন্তু এই সকল উপাদান আমাকে সেসময়ে বাধ্য করেছিল।
এ বিষয়ে কথা যেহেতু শুরু হয়েই গেল, তখন আর চুপ থেকে তো লাভ নেই। তাই সাহস করে জিজ্ঞাস করে উঠলাম, "জি, আপনার পায়ের এই দুর্দশা হলো কি করে?"
আবার একটি মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, "খুশিতে। অতিরিক্ত মাত্রার খুশিতে।"
শুনে অবাক হলাম। সাথে সাথে আবার জিজ্ঞাস করলাম, "কি?"
"কাহিনীটা বেশ বড়। শুনতে হলে অধিক পরিমাণের মনোযোগের প্রয়োজন হবে। পারবে তো?"
"জি! অবশ্যই!"



"ঘটনাটি এখন থেকে প্রায় বারো বছর আগের। গ্র্যাজুয়েশন পার করে মাত্র আইনজীবী হলাম। সেই উপলক্ষে আমি এবং আর ল কলেজের সহপাঠীরা সবাই মিলে রাতে পার্টি করছিলাম। দারুণ মজা হচ্ছিল। যে মেয়েটাকে পছন্দ করলাম, তারই সঙ্গে সারাটা রাত নাচলাম। মেয়েটার নাম ছিল মারজিয়া।"
"বাহ! কি সৌভাগ্য আপনার!"
"হূ!"
"মেয়েটাকে আপনার মনের কথা বলেননি?"
"বলেছিলাম। সে বলছিল, সেও নাকি আমাকে অনেক আগ থেকেই পছন্দ করত।"
একটা মুচকি হাসি দিয়ে জিজ্ঞাস করলাম, "তারপর কি হয়েছিল?"
উনি ও একটা মুচকি হাসি দিয়ে আবার বলতে লাগলেন, "হায়, কি পরিমাণের মদ পান করলাম না সেই রাত! আহাহা! বলার বাইরে! নেশাও চড়েছিল প্রচুর পরিমাণের।"
"আপনি মদও খান?"
উনি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালেন।
আমি জিজ্ঞাস করলাম, "তারপর কি হয়েছিল?"

১০



"তারপর আর কি হবার? যা কপালে ছিল, সেটাই হলো। মারজিয়ার সঙ্গে তিনটা ঘণ্টার মতো নাচার পরে বাসার জন্য বেল হলাম। সেই নাচটা কখনওই ভোলার মতো না রে! জীবনের শেষ নাচ ছিল। এখন শুধু চিন্তা করি, পা দুটো যদি শেষ পর্যন্ত নাচানাচির কাজে না লাগাতাম! এখন তো সারাজীবন এই সত্যটা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে।"
"আপনে তো তাও আপনার পছন্দের কাজটা করেই পা হারালেন, তাই না? অন্তত সেই স্বপ্নটা তো পুরণ হলো।"
"তা তো আছেই! তবে সারাটা জীবন হাঁটাচলার তুলনায় এই তিন ঘণ্টার নাচানাচি কিছুই না।"
"তা তো অবশ্যই! তারপর কি হয়েছিল, বলুন?"
"বাসার জন্য যখন বের হলাম, তখন মাথাটা প্রচুর টাল হয়েছিল। এত রাতে নেশা নামানোর জন্য লেবুও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সেই রাত বৃষ্টি হয়েছিল। রাস্তাঘাট বেশ পিচ্ছিল ছিল। আমি এত অন্ধকারের মধ্যে পায়ে হেঁটে সড়ক পার করতে গিয়ে, পা পিছলে, পিঠের উপর পড়ে গেলাম। ঠিক সেই সময়ই একটা বিশাল ট্রাক সেই সড়ক দিয়ে যাচ্ছিল। ট্রাকটার চাকা গেল আমার পায়ের উপর দিয়ে। সেখানে আশেপাশের কিছু লোক এই কাণ্ড দেখে দ্রুত ট্রাককে থামায় এবং আমাকে নিয়ে যায় নিকটবর্তী হাসপাতালে।"

১১



“কপালটা বড়ই খারাপ ছিল আপনার।"
"তা তো ছিলই। ছয় ঘণ্টা অপারেশনের পরে জ্ঞান ফিরে পেয়েছিলাম। জ্ঞান ফেরার পরে উঠে প্রথমেই যা দেখলাম, তা দেখার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না।"
"বড়ই কষ্টের ব্যাপারটা।"
"কিন্তু তার চেয়েও বেশি কষ্ট লাগল, যখন দেখলাম সেই মেয়েটিই আমাকে দেখতে আসল না, যার প্রেমে এত মদ খেয়ে মাতাল হয়ে এই কাণ্ডটা ঘটালাম।"
"ফোন করেও জিজ্ঞাস করেনি?"
"কীসের! উল্টো যখন আমি তার খবর নিতে ফোন দিলাম, তখন আমাকে কত আজেবাজে কথা শোনাল।"
"সত্যি?"
"তোমার কাছে মিথ্যা বলে আমার কোনো লাভ আছে?"
"সেটা না। আমি ভীষণ ঝটকা খেলাম কথাটা শুনে। এত জঘন্য কেউ হতে পারে? তাও আবার একটা মেয়ে! এতটাই নিষ্ঠুর! আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না।"
"হুম! অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই সত্য।"
"আপনি পাল্টা কোনো জবাব দেননি?"
"না!"
"কেন? সে আপনাকে অপমান করেই গেল, আর আপনি শুনেই গেলেন!"
"হ্যাঁ! ছোটবেলায় বাবা শিখিয়েছিলেন, শিক্ষকদের কখনও পাল্টা জবাব দিতে হয় না।"
আমি এই কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলাম, "মেয়েটা আপনার শিক্ষিকা ছিল?"
"হ্যাঁ! কিন্তু পড়া লেখার জগতে নয়, বরং জীবনের।"

১২



"মানে বুঝলাম না!"
"আরে বাবা, শিক্ষকেরা তো সাধারণত পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান দিয়ে থাকে, সেখানে তাদেরও যদি কোনো কথার পাল্টা জবাব দেয়া উচিত না, তাহলে তো যেই শিক্ষিকা জীবনের এত বড় একটা শিক্ষা দান করেছে, তাকে কি করে পাল্টা জবাব দেয়া যায়? সেই তো সেরা শিক্ষা দান করেছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই শিক্ষাই কাজে আসবে। ঐ পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান সবই এর সামনে তুচ্ছ।"
"হুম! বুঝতে পেরেছি।"
"তবে একটা কথা না বললেই নাই।"
"সেটা কোনটা?"
"আমার জীবনের প্রথম মামলা লড়েছিলাম সেই ট্রাক ড্রাইভারের বিরুদ্ধে। ঘটনাটা ঐতিহাসিক হয়ে রয়ে গেল।"
"বাহ্! এভাবে তো ভেবে দেখিনি।"
"সেটাই! জীবনে ঘটা প্রত্যেকটি মুহূর্তের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে কিছু অমৃত স্মৃতি। অনেকেই তা অবহেলা করে এড়িয়ে যায়।"
"আপনি কি সেই সকল কিছুই স্মরণ করেন?"
"না! তবুও অনুভব করতে পারি।"
"বাবা আপনার সম্বন্ধে যা কিছু বলেছিলেন, সবই দেখি সত্য।"
একটি মুচকি হাসি দিয়ে আমার চেহারার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাস করলেন, "কেন? তুমি কি মিথ্যে মনে করছিলে?"
"ব্যাপারটা ঠিক তা না। কিন্তু অন্য কারো সম্বন্ধে এত প্রশংসা উনার মুখে খুবই কম শুনেছি। তাই অনেকটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল আমার কাছে।"
"আচ্ছা? এমন কি বললেন আমার ব্যাপারে?"
"বলছিলেন; আপনি নাকি এতই জ্ঞানী এবং দক্ষ, যে সূর্য থেকেও আলো হস্তক্ষেপ করে চাঁদকে দিয়ে দিতে পারবেন।"

১৩



"হা হা হা! কথাটা কিছু ঘুলিয়ে ফেলেছ, বাবা। কথাটা একটু অন্যরকম ছিল। আর এটা তোমার বাবা সর্বপ্রথম বলেননি, এটা আমাকে জাপানে এক থেকে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সেখানের খুবই বিখ্যাত একজন বিতর্ককারী আমার কাছে হারার পর বলেছিলেন। সেই উক্তিটাই তোমার বাবা টেলিভিশনে দেখার পর আমাকে সেটার বাংলা অনুবাদ জিজ্ঞাস করেছিলেন। আমি সেটাই উনাকে অনুবাদ করে বলেছিলাম।"
"ওহ্! বুঝতে পেরেছি।"
"এবার নিজের সম্পর্কেও কিছু বলো।"

"আমার নাম রাফি। নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। পড়াশোনা ছাড়ার কিছু বছর গেল।"
"এর মাঝের কয়টা বছর কি করলে?"
"জি, এলাকার রাজনীতিতে ঢুকেছিলাম। মিছিল-টিছিলে যেতাম। বক্তৃতাগুলোতে হাজিরা দিতাম। আর মাঝেমধ্যে চাঁদাবাজি করে বেড়াতাম। বাস! এতটাই।"
"এতটাই? অনেক কিছুই তো করেছিলা! পদ পাওনি কোনো?"
"না! সেটার জন্য তো অনেক সময় লাগে। আর রাজনীতিতে বড় কোনো আত্মীয় না থাকলে তো সারাজীবন পদ ছাড়াই থাকা লাগে।"
"ওহ্! ওদের সঙ্গে অন্য কোনো ধরনের অন্যায় কাজে জড়াওনি তো?"
"অনৈতিক বলতে?"
"খুনখারাবি, লুঠপাট, ধর্ষণ ইত্যাদি ইত্যাদি।"
"তেমন কিছু না। কিন্তু যে নেতার অধীন কাজ করতাম, সে একটা খুন করেছিল। সেই খুনের সহায়ক হিসেবে একটা ছোট্ট ভূমিকা পালন করেছিলাম আমি।"
"কেমন ভূমিকা?"
"আমি গেটের বাহিরে দাড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিলাম।"
"এটিকে ছোট ভূমিকা বলছো, মিঞা! এটা তো একটা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছ।"
"আমি জানতাম না, তারা যে খুন করে ফেলবে।"
"যাক! অনেক কথাই হলো। আজকের জন্য এইটুকুই। বাকি কথা বলার জন্য অনেক সময় পড়ে আছে। এবার গিয়ে বিশ্রাম করো। কাল থেকে তো তোমার কাজ শুরু।"
"জি!" এটা বলেই আমি উনার রুম থেকে বের হয়ে চলে গেলাম।"

সেদিন আমাদের মাঝে এতটাই কথা হলো। বাকিটা সময় কাটল নীরবতার মাঝে।

0 Reviews:

Post Your Review