ঘনিষ্ঠতা - Emperor's Empire
SUBTOTAL :
ঘনিষ্ঠতা

ঘনিষ্ঠতা

Short Description:

Product Description

ঘনিষ্ঠতা




উনার দলিলপত্রের কাজ শেষ হবার পর, সাহস করে উনার কাছে গেলাম সেই ঘটনা নিয়ে কিছু আলাপ আলোচনার জন্য। অ্যাডভোকেট সাহেব আমার কিছু বলার আগেই বললেন, "এসো! এসো! বসে পড়ো।"
আমি চুপচাপ বসে পড়লাম। অ্যাডভোকেট সাহেব আমার দিকে গম্ভীরভাবে তাকিয়ে দু-চারবার একটা মুচকি হাসি দেওয়ার খুব চেষ্টা করছিলেন। দেখে এমন মনে হচ্ছিল, যেমন উনি আমাকে কিছু বলতে দ্বিধা বোধ করছিলেন। ব্যাপারটা এত সাংঘাতিক না হলে সে মুহূর্তে হেসেই দিতাম। তবে অবশেষে বলেই ফেললেন, "আজকে তুমি নিজ চোখে যা কিছু দেখেছ, সেটা কখনওই তোমার স্মৃতি থেকে বের করা সম্ভব না। তবে, এটা মনে রেখেও নিজের বাকি জীবন কাটানো সম্ভব। কারণ যদি আমি এটা করতে পারি, তবে তুমিও অবশ্যই পারবে।"
আমি কোনো অতিরিক্ত বিষয়ে আলোচনা না করেই সরাসরি মূল কথায় এসে পড়লাম, "একজন জীবিত লোককে এভাবে নির্মমভাবে হত্যা করাটা কি ঠিক হয়েছে?"
অ্যাডভোকেট সাহেব আমার প্রশ্নটা শুনে কিছুটা অবাক হলেও, উনার চেহারা দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল; এটা উনার প্রথমবার নয়। উনি একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, "সেই লোকটা একজন খুনি ছিল, সেটা মনে আছে তো?"
"জি! অবশ্যই। কিন্তু তার জন্য তো আইনি ব্যবস্থা আছে, তাই না?"
"হা হা হা! কোন যুগে বসবাস করছ, বাবা? আইন কি আর আগের অবস্থায় আছে?"
"না থাকলেই বা কি? একজন আইনজীবী হিসেবে কি আপনার কোনো নৈতিক দায়িত্ব নেই?"
"আমার নৈতিক দায়িত্ব সর্বপ্রথম আমার নিজের জন্য। আর আমি না মারলে, সে কিছুদিন পর এমনিতেও মারা যেত। তার বিরুদ্ধে খুবই মজবুত দলিল ছিল। আমি এমন কোনো কেস লড়ি না, যেটা নিঃসেন্দহে হেরে যাবো।"
"আপনি তো তাদেরকে একবার মানা করেছিলেনই, আবার হ্যাঁ বলে এসব করার কি দরকার ছিল?"



"আরে বাবা, তুমি তো শুধু এই একটা ঘটনা দেখলে। আরো কত যে এমনই অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। কিছুদিন আমার সঙ্গে থাকলে এসবের অভ্যাস হয়ে যাবে।"
"আমি তো এসবের অভ্যাস লাগাতে চাই না।"
"তাহলে চাও টা কি, হ্যাঁ? বাহিরে গিয়ে সবাইকে বলে ফেলতে চাও? এতটা মনে রেখ, তুমিও আমার সঙ্গে ছিলে, একথা কিন্তু দীপু ভাল করে জানে। কোনো ধরনের মামলায় আমি পড়লে, সেখানে তোমার নামও অবশ্যই আসবে। আর আমি নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে সহজেই ছুটে যেতে পারব।"
"আমি তো সেই লোকটাকে কখনও হাতও লাগাইনি। আমাকে তো কোনোভাবেই দোষী প্রমাণ করতে পারবেন না।"
"হা হা হা! সেটা তো একদম যৌক্তিক একটা কথা বলেছ। আমি তো কোনোভাবেই তোমাকে দোষী প্রমাণ করতে পারব না। তবে এখানে প্রমাণে ততটা প্রয়োজন নেই, যতটা দরকার যুক্তির।"
"ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।"
"নিজের বাবার কথাগুলো মনে করলে সবই বুঝতে পারবা।"
"বাবার কোন কথাগুলো?"
"আরে বাবা, যে ব্যক্তি সূর্যের আলোর প্রকৃত অধিকারী হিসেবে যদি চাঁদকে প্রমাণ করতে পারে,সেই ব্যক্তি কি এমন একটা হত্যার আসামি হিসেবে তোমাকে দোষী প্রমাণ করতে পারবে না? এটা কি কখনও হতে পারে, বলো?"
"দেখুন, আমি কখনওই আপনার বিরোধিতা করার কথা বলিনি। আমি শুধু সহজ একটা প্রশ্ন করেছিলাম।"
"সেটার উত্তর কি আমি দেইনি?"
"দিয়েছেন, কিন্তু আংশিক; পুরোপুরি এখনও দেননি।"
"সেই প্রশ্ন নিয়ে আমরা সারাটা রাত আলোচনা করতে পারি, কিন্তু সেই আলোচনার মাধ্যমে না সেই লোকটা ফিরে আসবে যাকে আমি খুন করেছি, আর না সেই লোকটা ফিরে আসবে যাকে সে খুন করেছিল। তাই সর্বোত্তম কাজটা হলো এই ব্যাপারে আর কোনো কথা আগে না বাড়ানো।"



"ঠিক আছে! যেভাবে আপনি ভাল মনে করেন।"
"এই তো! শাবাশ! বুঝতে পেরেছ এতক্ষণে।"
"তবে আমার একটা বিষয় নিয়ে বিশাল কৌতূহল ছিল।"
"হ্যাঁ! বলো।"
"সেই লোকজনকে দিয়ে যে এত কিছু করালেন, তারা কি আদৌ নিজের মুখ বন্ধ রাখতে পারবে?"
"অবশ্যই পারবে! তাদের কাজই এটা। তারা হলো আমার ব্যক্তিগত সুইপারের মতো। তাদেরকে দিয়েই নিজের জীবন থেকে আবর্জনা পরিষ্কার করি।"
"খরচও তো নিশ্চয়ই বড় মাপের হওয়ার কথা।"
"সেটা তো আছেই। প্রত্যেকটা কাজের জন্য এক লক্ষ করে দেই প্রত্যেককে। আজকাল তো টাকা ছাড়া পোষা কুকুরও পাশে থাকতে চায় না, এরা তো তাও রাস্তার কুকুর।"
"হুম! বুঝতে পেরেছি।"
"তবে, এই হত্যাগুলো না করলেই হয় না? তাহলে তো আর এত টাকাও খরচ করতে লাগত না।"
"আরে বাবা, যেদিন জীবনে শীর্ষ কোনো পর্যায়ে পৌছাবা, সেদিন বুঝতে পারবা; দুনিয়ার সামনে নিজের সম্মান কীভাবে নিজের জীবনের চাইতেও মূল্যবান হয়ে ওঠে। সেদিন মৃত্যুর চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর হবে অপমান।"
আমি একটু মাথা নিচু করে, আবেগাপ্লুত হয়ে বললাম, "এমন কোনোদিন দেখা কপালে আছে কি না, তা জানি না। তবে আপনার কথাগুলো শুনে সেই জগৎটা দেখার অনেক ইচ্ছা আছে। কিন্তু সেটার জন্য দরকার আপনার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা এমং কর্মদক্ষতার, যা আমার মধ্যে বিদ্যমান না।"
"সেটা থেকে একটা কথা মনে পড়ল। তোমার বাবা বলেছিলেন, তুমি নাকি ছোটবেলায় অনেক মেধাবী ছাত্র ছিলে, নবম শ্রেণীতে ফেল করলে কি করে?"
আমি ভীষণ লজ্জার সঙ্গে বললাম, "আসলে, ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয়।"
"মানে?"
"মানে হলো গিয়ে, আমি নবম শ্রেণীতে ফেল করিনি। তবে পাশ করার সুযোগও পাইনি।"
"কেন? কি হয়েছিল?"



"কাহিনীটা বেশ একটা বড় না হলেও, আমার জীবন বিশাল প্রভাব ফেলেছে। আমি তো পড়তাম একটা সরকারি স্কুলে। আপনার তো জানার কথা, সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সুন্দরী এবং জুয়ান কর্মী দেখা খুবই সচরাচর। তাই একটা শিক্ষিকাও যদি অল্প সুন্দরীও হয়, তাও সবাই তার প্রতি সর্বোচ্চ আগ্রহ প্রদর্শন করে। আমার বেলায়ও সেটাই ঘটেছিল। একদিন ক্লাসে বসে সবাই গণিত ক্লাস শুরুর অপেক্ষা করছিলাম। সেদিন নতুন একজন শিক্ষিকা আমাদের স্কুলে যোগদান করলেন। ধবধবে ফর্সা ত্বক, কোমল গোলাপি ঠোঁট, ঘন কালো চুল, চিকন দেহের আকৃতি এবং সেই সুন্দর দেহের উপর সাদাকালো শাড়ি। উনার চলার ধরন তো ছিল টেলিভিশনের নায়িকাদের মতো। আমি তো প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে আহত হয়ে গেলাম। নতুন ম্যাডাম নিজের পরিচয় দেয়ার পরই পড়ানো শুরু করলেন। সেদিন জ্যামিতি পড়াচ্ছিলেন। চিত্র আঁকতে বোর্ডের দিকে ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে উনার পিঠের দিকে আমার নজর পড়ল। নজর পড়তেই আমার মুখ থেকে শিস বেজে উঠল। আমি মাঝারি সারিতে বসেছিলাম, তাই আমাকে প্রথম দেখায় খুঁজে পাননি। কিন্তু তার কিছুক্ষণ পরই, চিত্র আঁকা শেষ করে একটা ঘোষণা করলেন। একটা মিষ্টি হাসির সঙ্গে পুরো ক্লাসকে জিজ্ঞাস করে উঠল শিসটা কে মেরেছে। অত্যন্ত স্বাভাবিক, আমি স্বীকার করিনি। তবে উনার ছলনা হতে আর কতক্ষণ বেঁচে থাকতে পারতাম? উনি আরেকবার মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন, উনার নাকি শিসের শব্দ বেশ পছন্দ এবং উনি নাকি তাকে পুরস্কার দিতে চান, যে শিসটা বাড়িয়েছিল। আমি তো সেই কোমল কোমল গোলাপি ঠোঁটের হাসি দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। পুরস্কারের কথা শুনতেই মনের মধ্যে অসংখ্য লাড্ডু ফোটা শুরু হলো এবং আমি দাড়িয়ে স্বীকার করে নিলাম শিসটা যে আমিই মেরেছিলাম। এটা স্বীকার করার কিছুক্ষণের মধ্যে আমি নিজেকে পাই মাননীয় অধ্যক্ষের, ভয়াবহ কক্ষে। কয়েকটা চর-থাপ্পড় খেলাম, বকাঝকা শুনলাম।


পুরস্কার নেওয়ার আশায় দাঁড়িয়েছিলাম, তিরস্কার নিয়ে বেড়িয়েছিলাম। অনেক হাত-পা জোর করার পর তারা বাসায় না জানানোর জন্য রাজি হলো। আমি বাসায় গিয়ে বলেছিলাম, বার্ষিকী পরীক্ষায় কোনো এক বিষয়ে ফেল করলেও স্কুল থেকে বের করে দিবে। পরবর্তীতে সেই অজুহাত বাস্তবায়নের জন্য পরীক্ষার বাহানা করে, স্কুলের পাশের গলির মধ্যে টঙের বেঞ্চে বসে বসে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতাম। পরীক্ষার ফলাফলের দিন বাসায় বলে দিলাম ফেল এসেছে বলে টি সি। এভাবেই শেষ হলো আমার শিক্ষাগত জীবনযাত্রা।"
অ্যাডভোকেট সাহেব আমার কাঁধে নিজের ডান হাত রেখে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, "তোমাকে তো বড়ই সহজ সরল ভাবছিলাম। তুমি তো মিঞা জিনিস একটা। পরিবার জানলে কষ্ট পাবে বলে, হাত-পা জোর করলা! আমি তো কখনওই এত ধৈর্য ধরে রাখতে পারতাম না।"



আমিও সামান্য হেসে বললাম, "অ্যাডভোকেট সাহেব, আপনার সঙ্গে আমার তুলনা হয় নাকি?" ডান হাত দিয়ে উপরে ইশারা করে বললাম, "কোথায় আপনি!" এবং বাম হাত নীচের দিকে ইশারা করে বললাম, "আর কোথায় আমি!"
অ্যাডভোকেট সাহেব জোড়ে একটা হাসি দিয়ে বললেন, "হা হা হা হা হা! ঠিকই বলেছ, বাবা! তোমার দু পা জমিন স্পর্শ করতে পারছে, কিন্তু আমি জমিনে থাকা সত্ত্বেও জমিনকে স্পর্শ করার মতো একটি পাও নেই। আমি ভাল করে জানি তুমি কি বুঝাতে চেয়েছ, তবে আমার এসবের প্রতি তেমন একটা রুচি নেই। কারণ লোকে তো বহু প্রশংসা করবে, কিন্তু দিন শেষে সেই প্রশংসাগুলোর কোনো মূল্য নেই। যদি থাকতো, তাহলে কারো প্রশংসার আর কোনো দরকারই পড়ত না।"
আমি কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করে বসলাম, "জি, প্রশংসার মূল্য থাকলে প্রশংসার দরকারই পড়ত না! কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।"
"সেটা এখন বুঝতে পারবাও না। এই জিনিসটা বুঝতে বুঝতে এতগুলি চুল পেকে গেল। তোমাকে যদি সহজ ভাষায় বলেই দেই, তাহলে সেটা শিক্ষণীয় নয় বরং প্রশিক্ষণীয় হবে।"


অ্যাডভোকেট সাহেবের অধিকাংশ কথাগুলো মাথার উপর দিয়ে গেল বললেই চলে। তবে কথাগুলো স্মরণে রাখতে চেষ্টা সর্বদাই। আমাদের কথার শেষে আমি আমার রুমে ফিরলাম। রুমে ফেরার কিছুক্ষণ পরই আবার মনে পড়ল সেই দুপুরবেলার ঘটনা। মনে পড়াতে নিজেই অবাক হলাম নিজের উপর। এত বিশাল ঘটনা কি সুন্দরভাবে ভুলে গেলাম কিছু মজাদার মজাদার গল্পের মাঝে! মা আসলে ঠিকই বলেছিল। আমার মাথায় আসলেই কিছু সমস্যা আছে। তবে ঘটনাটা যতক্ষণ ভুলে গিয়েছিলাম, ততক্ষণ প্রচুর শান্তিতে ছিলাম। আসলে, ব্যাপারটা একটু নতুন নতুন মনে হলেও, আমার জন্য প্রথম না। কারণ অ্যাডভোকেট সাহেবের সঙ্গে যতক্ষণ গল্প চলছিল, ততক্ষণ উনি আমার কথাগুলো বেশ গুরুত্ব দিয়ে শুনছিলেন। উনার চেহারার ভাবভঙ্গি দেখে বোঝাই যাচ্ছিল উনি আরো শুনতে আগ্রহী। এমন দীর্ঘ আগ্রহ দিয়ে আমার কথা গতবার শোনা হয়েছিল সেদিন, যেদিন বাসায় এসে সবাইকে বলেছিলাম; আমাকে স্কুল থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। সেদিনই আমার কথাগুলো সর্বোচচ গুরুত্ব, আগ্রহ এবং নিন্দা পেয়েছিল।


তার আগে কখনও স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারিনি, এমন হতে পারে। ছোট থেকে বড় হলাম এ মনে করে, গুরুত্ব কখনও নিন্দনীয় বস্তুর প্রতি দেয়া যায় না। কিন্তু স্কুল থেকে বের হবার পর সেই শিক্ষাও পেয়েই গেলাম। সেদিন যা ঘটেছিল, তাকে স্বপ্ন বলে ভুলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এই মানসিকতা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে, নাহলে দুনিয়াতে আরো অনেক অজানা রহস্যই আছে যা মানুষের না জানাটাই উত্তম। এসব গভীর চিন্তা শেষে ঘুমোতে গেলাম। চোখ বন্ধ করার কিছু সময়ের মধ্যেই সেই লাশটি চোখে ভেসে উঠছিল। সাথে সাথে চমকে উঠে বসে পড়লাম। এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল দম আটকে গিয়েছে। নিশ্বাস ফেলতে কিছুটা কষ্ট হচ্ছিল। সেই রাত আরো কয়েকবার এমন হবার পর সিদ্ধান্ত নিলাম জেগে থাকার। তবে এই সিদ্ধান্তে আসার কিছুক্ষণ পর পানি পান করতে গেলাম রান্নাঘরের দিকে। তখন বুঝতে পারলাম আমিই একমাত্র ব্যক্তি নয় যার ঘুমোতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। অ্যাডভোকেট সাহেবের রুমের বাতিটা জ্বালানো ছিল। দরজা লাগানো থাকার কারণে, আস্তে করে, দরজার নিচের ফাঁক দিয়ে, উঁকি মেরে দেখলাম। দেখলাম উনার রুমে টেলিভিশন চালু আছে এবং অ্যাডভোকেট সাহেবের হুইলচেয়ারটির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম; উনি টেলিভিশনের ঠিক বিপরীত দিকে ঘুরে আছেন। আমি দেখে খুবই অবাক হলাম। একটা লোক টেলিভিশন চালু রেখে কেনই বা তার ঠিক উল্টো পাশে ঘুরে থাকবেন? ব্যাপারটা খুবই অযৌক্তিক ছিল।


কিন্তু তখনই রুমের ডান পাশ দিয়ে দেখি দুটো পা হেঁটে, হুইলচেয়ারের দিকে আগে বাড়ছে। আমি "চোর! চোর!" বলে চিৎকার দেবার আগেই খেয়াল করে দেখলাম পা দুটো মোটেও স্বাভাবিক নয়। বরং আরো ভাল করে নজর দেওয়াতে বুঝতে পেলাম পা দুটো তো আলাদা পা। একবার একটি পত্রিকার খেলার পাতায় দেখেছিলাম এমন পা। সেখানে একজন পা বিহীন মেয়ে সেটার মাধ্যমে একটি বিশ্বসেরা দৌড় প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করেছিল। ইহার নাম ঠিক মনে নেই, তবে বাস্তবে দেখার অনেক আগ্রহ ছিল। কিন্তু আগ্রহ তো তখনই পুরণ হবে, যখন জীবনটা বাকি থাকবে। আমি সেখানে চোরের মতন লুকিয়ে লুকিয়ে দৃশ্যগুলো দেখার কারণে মনে এক বিশাল দুশ্চিন্তা কাজ করছিল। যদি ধরা খেয়ে যাই? যদি আমাকে চোর মনে করে, আমাকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেন? যদি আমার এই আচরণে অ্যাডভোকেট সাহেব আমার উপর অসন্তুষ্ট হন? আরো অনেক দুশ্চিন্তা তখন মাথার ভেতর ঘুরঘুর করছিল।

১০


এমন এক পরিস্থিতিতে হৃৎপিন্ডের গতি তো বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়ে ফেলার মতো অবস্থা হয়ে যায়। সেই অত্যন্ত জটিল একটি পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছিল আমার হৃৎপিন্ডের শব্দ আমি জোরে জোরে শুনতে পাচ্ছিলাম। মানুষ এমতাবস্থায় নিজেরই হৃৎপিন্ডের শব্দ শুনে আরো বেশি ঘাবড়ে যায়। তখন তার সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান করণীয় হয়ে পড়ে সেখান থেকে পালানো। ভাগ্যবশত, টেলিভিশনের শব্দের কারণে আমার হৃৎপিন্ডের কোনো শব্দ ভেতরে শোনা যাচ্ছিল না। একদিক দিয়ে চিন্তা করছিলাম রুমে ফিরে যাওয়ার, আরেকদিকে মনের সেই দৃঢ় আগ্রহ বলছিল; সেখানে বসে থেকে আরো দেখতে। কিন্তু আমি এত সহজে নিজের মনের ফাঁদে ফাঁসার লোক না। আস্তে করে সেখান থেকে উঠলাম এবং খুবই সাবধানে নিজের রুমের দিকে ফিরে গেলাম। রুমে ফেরার পর বড় একটা দম ছাড়লাম। তৎকালীন অনুভূতিটা অতি ভয়ঙ্কর হলেও, রুমে ফেরার পর বেশ তৃপ্তি পেয়েছিলাম। আসলে, তৃপ্তি না বলে এটাকে এক বিশেষ ধরনের আনন্দও বলা যেতে পারে। একটি বিপদ থেকে বেঁচে থাকতে পারাটা যেমন সৌভাগ্য, বিপদে পড়ে আবার ঠিকঠাক অবস্থায় ফিরে আসাও একটি অন্যতম প্রাপ্তি।

0 Reviews:

Post Your Review