আইনি শিক্ষা - Emperor's Empire
SUBTOTAL :
আইনি শিক্ষা

আইনি শিক্ষা

Short Description:

Product Description

 

আইনি শিক্ষা



অ্যাডভোকেট সাহেব বড়ই চতুর একজন লোক, তা তো আগে থেকেই জানা ছিল। কিন্তু উনার চতুরতার একটা বড় উদাহরণ পেলাম সেই মিশনের পরিকল্পনা শুনে। আমি কখনও ভাবতে পারিনি, এমনভাবে কাউকে ফাঁসানো যায়। খুবই সুপরিকল্পিতভাবে আমি সারাদিন লুকিয়ে লুকিয়ে লোকটার পেছনে পেছনে গেলাম। সারাদিন উনার প্রত্যেকটা কার্যক্রম নোট করে, সেই তথ্যাদি অ্যাডভোকেট সাহেবের কাছে প্রেরণ করলাম। পরিকল্পনা অনুসারে লোকটা কিছু সময় পর পর রাস্তায় হাঁটাচলা থেকে শুরু করে, বাসায় প্রবেশ করার সময় পর্যন্ত সেই পতিতার সঙ্গেই ফোনে আলাপ করছিল। লোকটা তার সুন্দর কন্ঠ এবং উত্তেজনাময় কথাগুলো শুনে কিছু সময়ের মধ্যেই তার সঙ্গে দেখা করার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল। ঠিক সেই মুহুর্তে সেই লোকটাকে ডাকা হলো সেই পতিতালয়ের দুতলায়। পতিতালয়টা মূলত একসময় একটা গার্মেনটসের কারখানা ছিল। তাই তার কিছু কিছু তলা ছিল টিনের। সেখানকার দ্বিতীয় তলায়ও ছিল ঠিক সেরকম টিনের ছাদ এবং টিনের মেঝ। অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে সেখানে পাঠালেন দালালের ভূমিকা পালনের জন্য। আমি সেখানে লোকটার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, তাকে তার রুম নম্বর বুঝিয়ে, তার হাতে চাবি ধরিয়ে বললাম, "এই নেন। রুমে গিয়ে লাইট আর ফ্যান ছেড়ে বসেন। আমি তাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।"




লোকটা আমার কথামতো উপরে গিয়ে, জুতোজোড়া খুলে, বাতি জ্বালানোর জন্য সুইচে চাপ দিল। চাপ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা বৈদ্যুতিক ঝটকা খেলো। সেই ঝটকা লেগেছিল কারণ লাইট বাল্বের সকেটের মধ্যে বৈদ্যুতিক তার সংযুক্ত ছিল যা সরাসরি লোকটার পায়ের নিচের লোহার অংশটির সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। তারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ যাতে সমগ্র মেঝেতে না ছড়ায়, তাই লোহার অংশটুকু আলাদা করে কেটে, তার আশেপাশের অংশটা কাঠের প্রলেপ দিয়ে আটকিয়ে রাখা হয়েছিল। এভাবে করে লোকটা নিজের হাতেই নিজের মৃত্যু ঘটিয়ে ফেলেছিল। তবে পরিকল্পনার এই অংশটুকু ছিল ভিন্ন। কারণ আমাকে শুধু বলা হয়েছিল, সে রুমে ঢুকে, বাতি জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে গুপ্ত ক্যামেরা চালু হয়ে যাবে। কিন্তু তা কিন্তু মোটেও হয়নি। বরং তাকে ডেকে ফাঁসানোর কোনো উদ্দেশ্যই ছিল না। শুরু থেকেই এটা ছিল অ্যাডভোকেট সাহেবের আরেকটি সুপরিকল্পিত একটি হত্যা। প্রায় দশটা মিনিট লোকটার শরীরে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছিল। লোকটা তো অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই মারা গিয়েছিল, কিন্তু শুধুমাত্র নিজের মনের সন্তুষ্টির জন্য লোকটার শরীরের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ করা বন্ধ করা হলো প্রায় দশ মিনিট পর।



সেই দশ মিনিট এমন পরিস্থিতির পরপর সমগ্র এলাকার বিদ্যুৎ চলে গেল প্রায় এক ঘণ্টার জন্য। এই একটা ঘণ্টার মধ্যে সেই লাশটি চুপচাপ সেখান থেকে বের করা হলো, বৈদ্যুতিক তারগুলো সরানো হলো। সেই লাশটি আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে গিয়ে, তার শরীর থেকে সুই দিয়ে রক্ত বের করা হলো। শরীর থেকে যখন আর রক্ত বের হচ্ছিল না, তখন শিরা কেটে, অবশিষ্ট রক্ত কেঁচে, বের করা হলো। তারপর তার শরীরের চামড়া ছুরির মাধ্যমে আলাদা করা হচ্ছিল। দৃশ্যটি দেখে মনে হচ্ছিল, কোনো গবাদি পশু জবাই দেয়ার পর তার দেহ থেকে যেভাবে চামড়া আলাদা করা হয়। এরপর খুবই সুন্দরভাবে, শরীরের মাংস কেটে ভাগ করা হয়। তার চামড়া এবং পরনের কাপড় পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল আগুনে। তার মাংসের টুকরোগুলো কিছুটা রাস্তার কুকুরদের খাওয়ানো হলো এবং তার অবশিষ্ট রান্না করা হলো, তার পরের দিন গরিবদের খাওয়ানোর জন্য। সেই এক ঘণ্টার মধ্যে লোকটার অস্তিত্ব এভাবেই মিটে গিয়েছিল। এসব করছিল অ্যাডভোকেট সাহেবের সেই নিয়োজিত লোকেরা। তারা উপরের এবং নিচের তলায় অপেক্ষা করছিল। সমস্ত এলাকা অন্ধকার হওয়াটা ছিল তাদের জন্য এক প্রকারের ইশারা।




জীবনে প্রথমবার একটা খুনে এত বড় ভূমিকা পালনের পর শেষমেশ বাসায় ফিরলাম। বাসায় প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, "আসার সময় সাবধানে এসেছো তো? পরিচিত কেউ আবার দেখেনি তো?"
উনার এই প্রশ্ন শুনে, আমি খুবই নিম্নস্বরে উত্তর দিলাম, "না। কেউ দেখেনি আমায়।"
"শাবাশ! তোমার জন্য টাকা রেডি করে রেখেছি। মোট আঠারো কোটি টাকা আছে।" একথা শুনে তো আমার খুশিতে লাফ দিয়ে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু আমার বিবেক আমাকে সেই আনন্দ অনুভব করার অনুমতি দেয়নি। সেই নিম্নস্বরেই জিজ্ঞাস করলাম, "কি দরকার ছিল এসব করার? লোকটাকে ফাঁসানোর উদ্যোগটাই তো ঠিক ছিল। তার হত্যা করার কি এমন প্রয়োজন ছিল, বলুন?"
"তাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে, তার উপর মামলা দিয়ে, তালাক হবার পরপর বৃষ্টির সঙ্গে বিয়ে করলে, সকল সন্দেহ আমার উপর এসে পড়ত। তাই সেটা না করে, এই পৃথিবী থেকে তার অস্তিত্ব মেটানোর ব্যবস্থাই করে ফেললাম।"
"এসব করতে কি আপনার বিবেকে কখনও বাধা দেয়নি?"

"একসময় এমন ছিল, যখন এগুলো নিয়ে শত শত রাত জেগে থাকতাম। এগুলো চিন্তা করলেও দেহের লোম দাঁড়িয়ে যেত। কিন্তু সেই সকল অনুভূতি এক বন্ধুর লাশের সাথে কবর দিয়ে এসেছিলাম।"
"বন্ধুর লাশ?"




"হ্যাঁ! স্কুলে পড়া কালীন সময়ে আমার এক বন্ধু ছিল; জুলকান। সে আমার সবচেয়ে কাছের এক বন্ধু ছিল। জুলকানের স্বপ্ন ছিল পৃথিবীর একজন ডাক্তার হবার। মানবসেবার প্রতি তার প্রচুর আগ্রহ ছিল। একদিন ক্লাস শেষে, সে স্কুলের বায়োলজি ল্যাবের মধ্যে ঢুকে পড়ে, কিছু কিছু প্রাণীর দৈহিক গঠন সম্বন্ধে কিছু তথ্য জোগাড় করার জন্য। সেদিন আমি তার সঙ্গে যাওয়ার প্রতি অরুচি প্রকাশ করার কারণে সে একা একাই ল্যাবে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে সে দেখে, সিনিয়র কিছু ছেলে সেখানে নেশা করছে। সে তাদের কাছে গিয়ে, সুন্দরভাবে তাদেরকে সেখানে নেশা করতে মানা করেছিল। এই মানা কারাটা এতই বড় অপরাধ হয়ে বসল, যে এটার জন্য তাকে তার জীবন হারাতে হলো। সেই জানোয়ারেরা মেরে ফেলল আমার বন্ধুকে আর আমি কিছুই করতে পারিনি। তাদের বিচারের বেলায়, টাকার সাহায্যে তাদেরকে নির্দোষ প্রমাণ করা হয়েছিল। সেদিন থেকেই আমি শপথ করলাম; যা বলিব, মিথ্যে বলিব, মিথ্যে বৈ, কিছু বলিব না। এটা আইনি শিক্ষার ঠিক বিপরীত। কিন্তু এই বিপরীত শিক্ষাটা একজন আইনজীবীর কাছ থেকেই শিখেছি।"




এরপর রুমে বাকিটা রাত বিরাজমান ছিল শুধু নীরবতা। এই নীরবতার আড়ালে, নির্লজ্জভাবে, সেই আঠারো কোটি টাকার ব্যাগ নিয়ে, প্রস্থান করলাম বাড়ির দিকে। ভাল করেই জানতাম, এখন এমন মানুষকে বোঝানো সম্ভব নয়। কেননা এমন মানুষের জ্ঞানের তুলনায় পৃথিবীর সকল জ্ঞান কেবল তুচ্ছ মনে হবে। জানি না আমি; এ ঘটনাগুলো ভুলতে কতটা সময় লাগবে, তবে অ্যাডভোকেট সাব্বির ক্বারির জন্য কাজ করা, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে থাকবে। কেননা যেই লোকটাকে জমির উপরে চলার জন্যও হুইলচেয়ারের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়, তার তো মোটেও কোনো প্রকার অহংকার থাকা উচিত না। কিন্তু কেবলমাত্র একটা কেদারায় ভ্রমণ করে জীবন কাটানোর সত্ত্বেও এত জ্ঞানী এবং ক্ষমতাসীন একজন ব্যক্তি দিন কাটায় অহংকার করেই। এই অহংকার তার পতন আনুক আর না আনুক, এই সমাজে ধ্বংস বয়ে আনবে নিঃসন্দেহে।

এর সাথেই শেষ করছি এই গল্প।

0 Reviews:

Post Your Review