এক বিশেষ সন্ধ্যা
১
পরের দিনই বৃদ্ধ লোকটি অ্যাডভোকেট সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের বাড়ির জন্য বের হলেন। সেদিন থেকেই মূলত আমার কাজ করার দিন শুরু হলো। অ্যাডভোকেট সাহেবের মক্কেলরা প্রায় প্রতিদিনই দেখা করতে আসতেন। অনেকে আসতেন পরামর্শ করতে, আবার অনেকে আসতেন নতুন কোনো মামলার প্রস্তাবনা নিয়ে। অনেক বড় বড় রাজনৈতিক দলীয় নেতাদের সঙ্গেও উনার বেশ ওঠাবসা ছিল। উনার দেখা করার সময় নির্ধারিত ছিল সকাল এগারোটা হতে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। এর মাঝেই দু ঘণ্টার বিরতি নিতেন খাবার এবং বিনোদনের জন্য। আমি প্রথম যেদিন এসেছিলাম, সেদিন ঠিক উনার বিরতির সময়টায়। কি ভাগ্য আমার! প্রথম দিনেই এলাম বিরতির সময় আহাসা! তবে বিকেল পাঁচটার পর যে উনার সকল কাজ শেষ হয়ে পড়ে, ঠিক তাও না। উনি বাকিটা সময় বিশেষ কিছু মামলার দলিলপত্র যাচাই করেন এবং বাকিটা রাত একা একা শান্তিপূর্ণভাবে আরাম করেন। শুধুমাত্র রাত দশটার দিকে খাবারের সময় উনাকে ডাক দেয়া যাবে, তার আগে বা পড়ে হলে খবর আছে।
২
এক বিশেষ সন্ধ্যা; অ্যাডভোকেট সাহেবের সঙ্গে উনার অফিস রুমে বসেছিলাম। হঠাৎ করে দরজা জোড়ে জোড়ে ঠকঠক করার শব্দ আসছিল। মনে হচ্ছিল যেমন দরজাটা ভেঙেই ফেলবে। আমি তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলতে গেলাম। দরজা খুলে দেখলাম দুজন বেশ লম্বা এবং মাস্তান প্রকৃতির লোক। তাদের মধ্যে একজন পড়েছিল সাদা একটা পাজ্ঞাবী, স্বর্ণের মোটা একটা চেইন এবং হাতে একটি স্বর্ণের হাতঘড়ি। দেখে বোঝাই যাচ্ছিল কোনো এক নেতা হবে। তার সাথের জন বেশ সাদাসিধে কাপড়ে ছিল, তবে চেহারার ভাবভঙ্গি দেখে বোঝাই যাচ্ছিল সে যে একটা নিতান্ত চামচা। আমি তাদের জিজ্ঞাস করলাম, "জি, কাকে চাই?"
দুজনের মধ্যে চামচা প্রকৃতির লোকটা আমাকে জিজ্ঞাস করলো, "উকিল সাহেব বাসায় আছেন?"
"জি আছেন! আপনারা কারা?"
তখন নেতা প্রকৃতির লোকটা উত্তর দিল, "আমি তার অনেক পুরনো মক্কেল। নাম; দীপু।"
"জি, ভিতরে আসুন। উকিল সাহেব অফিস রুমে আছেন। আমি ডেকে আনি।"
"না থাক্! আমরা অফিসের কাজেই এসেছি।" এ বলে তারা আমার দুপাশ দিয়ে অফিস রুমের দিকে চলে গেল।
৩
অ্যাডভোকেট সাহেব তাদেরকে অফিসের মধ্যে প্রবেশ করতে দেখে, চিৎকার করে আমাকে ডাক দিলেন। আমি দৌড় দিয়ে সেখানে হাজির হলে আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, "তুমি কি মনে করে এদেরকে ভেতরে আসতে দিলা? দেখতে পারছ না আমি ব্যস্ত আছি?"
আমি কিছু বলার আগেই দীপু নামক ব্যক্তিটি বলে উঠলেন, "উকিল সাহেব, অনেক জরুরি কাজ ছিল। হাতে একটুও সময় ছিল না।"
"কি হয়েছে এবার? কাকে খুন করে এসেছ?"
"আরে, এবার আমি কিছু করিনি।" বলে লোকটা নিজের সাথের লোককে উদ্দেশ্য করে বললেন, "এই আমার খুব কাছের এক ছোট ভাই, নাম; নয়ন।"
"হ্যাঁ! তারপর?"
"এলাকার মধ্যে একটা ছোটখাটো গণ্ডগোল হয়েছিল জমিনের ব্যাপারে।"
"সরি! আমি জায়গা-জমিনের মামলা লড়ি না। অন্য কারো কাছে যাও।"
"আরে ভাই, কথাটা তো আগে ঠিকমতো শুনেন!"
"আমার কাছে এতো গল্প শোনার সময় নেই। অনেক কাজ বাকি আছে। যা বলার তাড়াতাড়ি বলো।"
"ঠিক আছে! ঠিক আছে! আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে গিয়ে; সেই গণ্ডগোলের মধ্যে এই বেচারাটা একটু মারধর করে বসল একজনকে। সে এটা রাগের মাথায় করেছিল। একটা শয়তান ছেলে, সেটার ভিডিও রেকর্ড করে অনলাইনে ছেড়ে দিল। তারপর সে ঐ ছেলেটিকে বোঝাতে গেলে ছেলেটা বেয়াদবি করে বসাতে সে ছেলেটাকে শাসন করে। শাসন করতে গিয়ে ছেলেটা ভুলবশত মারা যায়।"
৪
অ্যাডভোকেট সাহেব রাগান্বিত সরে বললেন, "আপনার কথাগুলো শুনলাম। এবার জান। এই কেস আমি লড়তে পারব না।"
"উকিল সাহেব, আপনার কাছে অনুরোধ করছি। আমাকে তো একবার সাহায্য করেছিলেন, এর বেলায়ও একটু দেখেন না!"
"তোমার বেলায় তোমার বিরুদ্ধে এত মজবুত মজবুত দলিল ছিল না। এর তো মারধর করার ভিডিও অনলাইনে রয়েছে। আর যে আপলোড করেছিল, তাকেই মেরে ফেলল! শালা গাধা কোথাকার! নিয়ে যাও একে এখান থেকে। গেট লস্ট!"
অতঃপর সেই চামচা প্রকৃতির লোকটা রেগে, চিৎকার করে, অ্যাডভোকেট সাহেবকে বললো, "বাস! অনেক শুনে ফেললাম। কখন থেকে দেখছি, যা মনে আসছে বকেই যাচ্ছেন। আমাকে যা বলেন না বলেন, দীপু ভাইকে উল্টাপাল্টা কিছু বললে কিন্তু আমি সহ্য করব না।" এই দৃশ্যটি দেখে, সেই নেতা প্রকৃতির লোকটা তাকে থামানোর প্রয়াসে, তাকে ধরে অফিস থেকে বের হতে লাগল। তবুও সেই চামচা প্রকৃতির লোকটা চিৎকার করে বলছিল, "শালা লুলার বাচ্চা, জেলে যেতে হলে তোর খুনটাও করেই যাব।"
এটা শুনে অ্যাডভোকেট সাহেব ভ্রূ কুচিয়ে বললেন, "আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি কেসটা লড়তে রাজি।"
৫
একথা শুনে তারা উভয়ই অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়ে গেল। তাদের কিছু বলার আগেই উনি আরো বলে উঠলেন, "কিন্তু একটা শর্ত রয়েছে।"
"কি শর্ত?" জিজ্ঞাস করলেন নেতা প্রকৃতির লোক।
"এই লোককে আমার কাছে কালকে এসে আমার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।"
"উকিল সাহেব, কালকে কেন, এখনই সে ক্ষমা চাবে।" বলে তার চামচাকে বললেন, "এই এক্ষুনি ক্ষমা চাও উকিল সাহেবের কাছে, বেয়াদ্দব। এখনই ক্ষমা চাও।" এই কথাটা শুনে সেই চামচা প্রকৃতির লোকটা অ্যাডভোকেট সাহেবের কাছে ক্ষমা চাওয়া শুরু করলো।
এই দৃশ্য দেখে অ্যাডভোকেট সাহেব বললেন, "এখানে আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে কোনো লাভ নেই। তুমি আমাকে এইমাত্র 'লুলার বাচ্চা' বলে গালি দিয়েছ। অর্থাৎ, এখানে তুমি মূলত আমার বাবাকে গালিটা দিয়েছ। তাই আমি চাই, কালকে দুপুরে তুমি আমার বাবার কবরের কাছে এসে, উনার কাছে ক্ষমা চাও।"
এটা শুনে নেতা প্রকৃতির লোকটা বলে উঠল, "ঠিক আছে! ঠিক আছে! সে কালকে দুপুরে সেখানে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিবে।"
"ঠিক আছে। তাহলে এবার তোমরা যেতে পারো।"
অ্যাডভোকেট সাহেবের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নেতা প্রকৃতির লোকটা বললেন, "ধন্যবাদ, উকিল সাহেব। অনেক অনেক ধন্যবাদ।" এরপর নিজের চামচাকে বললেন, "চলো! কাজ হয়ে গিয়েছে।"
৬
তারা বাসা থেকে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর অ্যাডভোকেট সাহেব একজনকে ফোন করলেন। ফোনের লোকটাকে বলছিলেন, "শুনো, তোমাদের জন্য নতুন একটা কাজ আছে। করতে পারবা তো?" আমি দূর থেকে শুধু এইটুকুই শুনতে পেরেছিলাম। পরবর্তীতে রাতে, খাবারের টেবিলে উনাকে জিজ্ঞাস করলাম, "আপনি কি আসলেই কেসটা লড়বেন? লোকটার বিরুদ্ধে তো অনেক বেশি পরিমাণের প্রমাণ রয়েছে।" আমার প্রশ্নের জবাবে অ্যাডভোকেট সাহেব একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, "আগে শর্তটা তো পূরণ হতে দাও রে, বাবা!"
শুনে অবাক লাগলেও, তখন এই ব্যাপারে বেশি একটা চিন্তা করিনি। শুধু অপেক্ষায় ছিলাম তার পরের দিনের দুপুরের।
0 Reviews:
Post Your Review