মেহমান - Emperor's Empire
SUBTOTAL :
মেহমান

মেহমান

Short Description:

Product Description

মেহমান



পরের সকালে ঘটল বেশ সাংঘাতিক এক ঘটনা। সকালে প্রায় নয় ঘটিকায় কলিং বেল বেজে উঠল। সাধারণত এত সকালে তো কেউ আসে না। আমি দরজা খুলে দেখতে পাই কমলা রঙের শাড়ি পড়া একজন সুন্দরী মহিলা। উনার গলায় ঝোলানো ছিল একটি পরিচয়পত্র, ডান কাঁধে ঝোলানো ছিল একটি কালো রঙের হ্যান্ডব্যাগ এবং হাতে ছিল একটি বেশ উন্নতমানের ক্যামেরা। দেখে বুঝতে পারলাম উনি একজন সাংবাদিক। জীবনে অনেক তো সংবাদ এবং সাংবাদিক দেখলাম, তবে উনার সঙ্গে তাদের তুলনা হয় না। উনাকে জিজ্ঞাস করলাম, "জি, কে আপনি?" যাহার উত্তর না দিয়ে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, "তুমিই নতুন কাজের লোক নাকি?" উত্তরে আমি বললাম, "জি! আপনি কি উকিল সাহেবের পরিচিত কেউ?" উনি সামান্য একটু বিরক্তির স্বরে জিজ্ঞাস করলেন, "আমি ওর কি হই না হই, এসব জেনে তুমি কি করবা?" উনার মেজাজ দেখে আমি সামান্য ঘাবড়ে গেলাম। এমন ঘাবড়ানো অবস্থায় বলে উঠলাম, "জি, আমি শুধু উকিল সাহেবের নির্দেশনা অনুযায়ী আপনাকে প্রশ্নটা করেছিলাম। আমাকে ভুল মনে করবেন না।" উনি কিছুটা মেজাজ ঠান্ডা করে বললেন, "ঠিক আছে! নতুন কাজের লোক তো, তাই ভুল মনে করে মাফ করে দিলাম। আগের থেকে যাতে এমন না দেখি, ঠিক আছে?"
"জি, অবশ্যই!"
"হুম! সাব্বির আছে বাসায়?"
"জি! উনি উনার রুমের ভেতর বসে সংবাদপত্র পড়ছেন। আপনি ওয়েটিং রুমে বসুম, আমি উনাকে দেকে নিয়ে আসি।"
"না, থাক্! আমি যাই ওর কাছে।"


আমি উনার সামনে গিয়ে থামানোর চেষ্টা করতে লাগলাম আর বললাম, "ম্যাডাম! ম্যাডাম! ম্যাডাম! উনার রুমে বিনা অনুমতি কারো প্রবেশ করার অনুমতি নেই।"
কিছুটা রেগে বললেন, "আবার বেয়াদবি! কি বলেছিলাম একটু আগে?"
"আমার সব মনে আছে, ম্যাডাম। কিন্তু একটু বোঝার চেষ্টা করুন। এটার কারণে আমার চাকরি চলে যেতে পারে।"
"চাকরি চলে গেলে আমার বাসায় নিয়োগ দিয়ে দিব। এখন সড় আমার সামনে থেকে।"
"ম্যাডাম, একটু তো বোঝার চেষ্টা করুন। প্লিজ!"
আমি উনাকে অনুরোধ করেই যাচ্ছিলাম, এমতাবস্থায় অ্যাডভোকেট সাহেব এসে আমার পেছন থেকে বললেন, "আরে বাবা, তাকে আসতে দাও। সে আমার খুব পরিচিত একজন।" এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি উনার কাছে ক্ষমা চেয়ে, উনার রাস্তা ছেড়ে দিলাম। উনি আমার দিকে বেশ ক্রোধের দৃষ্টিতে তাকিয়ে অ্যাডভোকেট সাহেবকে জিজ্ঞাস করলেন, "সাব্বির! তুমি এই ছেলেটাকে আমার প্রসঙ্গে এর আগে কিছু বলোনি?"
উত্তরে অ্যাডভোকেট সাহেব সামান্য হেসে বললেন, "না! বলার সময়ই পাইনি। এত ব্যস্ততার মাঝে শুধু হাতেগোনা কয়েকজনের সাথেই পরিচয় করানো হলো।"
"অন্তত আমার কথাটা তো একবার উল্লেখ করে দিতা! জানো, এতক্ষণ ধরে কি আজগুবি আজগুবি প্রশ্নর সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমার?"
"হা হা হা! সাংবাদিকতার মাধ্যমে কয়জনের কাছে কতগুলো আজগুবি প্রশ্ন করেছিলা, সেটা মনে আছে তো? এই সামান্য কিছু প্রশ্ন সেগুলোর সামনে কিছুই না।"
"আমি কিন্তু মোটেও হাসিঠাট্টা করার মুডে নেই।"
"আরে সরি বাবা! ভুল হয়ে গিয়েছে।"


আমি মাঝখান দিয়ে বলে উঠলাম, "উকিল সাহেবের কোনো দোষ নেই। উনি সারাদিন কাজের ব্যস্ততার মাঝে মোটেও সময় খুঁজে পান না।" আমার উত্তরটি শুনে ম্যাডামের চেহারায় কেমন অবাক একটা ভাব এসে পড়ল। মুখে হাত দিয়ে, সামান্য একটি কাঁসি এবং তার সঙ্গে একটি হাসি দিয়ে, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "ঠিকই বলেছ।" আবার অ্যাডভোকেট সাহেবের দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিম্ন স্বরে বললেন, "তার জীবনে কাজ ছাড়া আর আছেই টা কি!" এটা বলে এক মুহূর্তের জন্য নীরব হয়ে, নিচের দিকে চেয়ে, আবার আমার দিকে চেয়ে, আমার ডান কাঁধে নিজের বাম হাত রেখে বললেন, "সরি! দোষটা আমারই ছিল। মনে কিছু নিও না, ঠিক আছে বাবা?" বলে একটা মায়াবী হাসি দিলেন। এরপর তারা উভয়ই অ্যাডভোকেট সাহেবের রুমের দিকে এগোলেন। আমি নিজের স্থান থেকে মোটেও নাড়াচাড়া করিনি। অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে ডেকে বললেন, "দুই কাপ গ্রিন টি নিয়ে আসো। একটার মধ্যে চিনি বেশি এবং অপরটা চিনি ছাড়া। আর দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে যেও।"
আমি উনার কথা অনুযায়ী দরজা ভিড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলাম গ্রিন টি তৈরি করতে। গ্রিন টি বানানোর সময় সর্বদা আমার মাথায় একটি প্রশ্ন ঘুরপাক করতো; "এটা আগের থেকেই এত তিক্ত, স্বাদে আমি বিরক্ত; তবুও দেখি ইহা পান করেই যাচ্ছে অহরহ ব্যক্তিত্ব।" এটা ছিল আমার অবসর সময়ে কবিতা চর্চার ছোট্ট একটি নমুনা। অতঃপর গ্রিন টিও তৈরি হয়ে গেল। ট্রেতে করে তাদের উভয়ের জন্য গ্রিন টি পরিবেশন করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু রুমের কাছে যাওয়ার সময় শব্দ পেলাম তাদের ঝগড়ার। এত আপন মানুষ হয়েও, এত তীব্র স্বরে ঝগড়া! বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে তাদের নিয়ে। আমি প্রথমে রুমে প্রবেশ করার সাহস পাচ্ছিলাম না, তাই চা এর ট্রে হাতে নিয়েই, ভেড়ানো দরজাটার ঠিক বাহিরেই, কিছুক্ষণ দাড়িয়ে ছিলাম। আমাকে দরজার ফাঁক দিয়ে খেয়াল করতে পেরে, ম্যাডাম ভিতরে ডেকে জিজ্ঞাস করলেন, "কি হলো? এভাবে বাহিরে দাড়িয়ে ছিলা কেন?"


আমি ঘাবড়ে গিয়ে এক মোটা ঢোঁক গিললাম। সাহস করে উনার চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলাম, "জি, আসলে হয়েছিলটা কি; আমি আসার সময় কিছু চিল্লাচিল্লির শব্দ শুনে থমকে গিয়েছিলাম। মনে করেছিলাম, এমন সময়ে হঠাৎ প্রবেশ করা উচিত না।"
কিছুটা চিন্তিত স্বরে, সন্দেহের নজরে আমার তরফ তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলেন, "কতক্ষণ ধরে দাড়িয়ে আছো এখানে এবং আমাদের কথাবার্তার কতটুকু শুনেছ?"
আমি উনার প্রশ্ন শুনে চমকে উঠে উত্তরে বললাম, "জি, আমি তো মাত্র আসলাম এবং কথাগুলো তেমন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল না। তাই চিল্লানোর শব্দ শুনতে পেলেও, কিছুই বুঝতে পারিনি।"
"সত্যি তো?"
"জি, আপনার বিশ্বাস না হয়ে থাকলে, আপনি স্বয়ং দরজার বাহিরে দাড়িয়ে দেখতে পারেন।"
"আচ্ছা! এ কথা? ঠিক আছে! তাহলে দেখে আসি তো আমিও।" এটা বলেই উনি দরজার দিকে এগোতে লাগলেন। তখনই অ্যাডভোকেট সাহেব নিজের বাম হাত দিয়ে উনার হাত ধরে উনাকে থামিয়ে বললেন, "এই! এসব কি শুরু করেছ? বসো তো। মাথা ধরে গেল তোমার এসব কান্ড দেখে। উফ্!" এটা বলেই নিজের ডান হাতটা নিজের কপালে রাখলেন।
অ্যাডভোকেট সাহেবের স্পর্শ পাওয়াতে; ম্যাডামের চোখে কেমন আজব এক ঝলমলে ভাব দেখা যাচ্ছিল। আমি দেখে বেশ অবাক হলাম। উনার চেহারায় তো নেতিবাচক কোনো মনোভাবের লক্ষণই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। অ্যাডভোকেট সাহেব যেমন শুধু হাতই থামাননি, তারই সঙ্গে থামিয়েছিলেন উনার অত্যাধিক মাত্রার ক্রোধ।


উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি; একটি বড়সড় আগুন নিমেষেই নিভে গেল শুধু একটি সামান্য ফুঁয়ের মাধ্যমে। আমি তো সেখানেই দাড়িয়ে এই বিস্ময়কর দৃশ্য দেখছিলাম। অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে বললেন, "এই রাফি, তুমি এখন যেতে পারো।" উনার আদেশ অনুযায়ী আমি রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমের দিকে ফিরলাম। তবে এই কৌতহলী মনকে সামলাতে পারছিলাম না মোটেও। মন তো চাচ্ছিলো; এক্ষুনি গিয়ে তাদের সকল কথাবার্তা কান পেতে শুনি। এমন একটা সময়ে মনকে বোঝানো বেশ কঠিন একটা কাজ। এমন কি অতি গুপ্ত আলাপ আলোচনা চলছিল তাদের মধ্যে, যে আমার এতই কঠিনভাবে প্রশ্ন করা হলো? এগুলো তো জানার পুরোপুরি অধিকার রয়েছে আমার। কেননা, আমি শুধু একজন কাজের লোক নই, আমি অ্যাডভোকেট সাহেবের জীবনের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশও। আমার কাছে কিছু লুকোনো উনার মোটেও উচিত না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম; যেভাবেই হোক, উনাদের কথা শুনেই ছাড়ব।


অ্যাডভোকেট সাহেবের রুম ছিল ঠিক রান্নাঘরের সাথে লাগানো। আমি খুব আস্তে আস্তে হেঁটে গেলাম রান্নাঘরের ভিতরে। সেখানে একটি কাচের গ্লাস নিয়ে তার প্রান্তের পাশটা রাখলাম সেই দেয়ালে যেটা সেই রুমের সঙ্গে জড়িত। ছোটবেলায় একটা সিনেমার মধ্যে এমন করে গোপন আলাপ শুনতে দেখেছিলাম। এখনও এই পদ্ধতি মনে রাখাটা এভাবে কাজে আসবে, কখনও চিন্তাও করতে পারিনি। নিজেকে কেমন গুপ্তচরের মতো লাগছিল। আমি গ্লাসের নিচের অংশটিতে নিজের বাম কান রেখে অপর কান আমার ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে বন্ধ করে রাখলাম। যেসব কথা হচ্ছিল তাদের মধ্যে, তা শুনে তো আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি শুনতে পারছিলাম; ম্যাডাম বলছিলেন, "চা বেশ ভালই হয়েছে। ছেলেটার মধ্যে চা সম্পর্কে ভালই জ্ঞান আছে।"
অ্যাডভোকেট সাহেব বলছিলেন, "তা তো আছেই! ট্রেইনার কে, বুঝতে হবে না? হা হা হা!"
"বাহ্! আজকাল এই কাজও নিজের ব্যস্ততার বাহানাগুলোর মধ্যে তালিকাভুক্ত করে ফেলেছ? সুন্দর তো!"
"করতেই পারি। অবসর সময় থেকে তো আমার এলার্জি আছে, এটা তো তুমি ভাল করেই জানো।"
"জানি দেখেই তো বেশি প্রশংসা করিনি।"
"প্রশংসা থেকে মনে পড়ল; গতরাতে তোমার উপহার ট্রায়াল দিয়ে দেখেছিলাম।"
"তাই? দুইটা বছর পর!"
"হ্যাঁ! সরি!"
"যাক্! কেমন লাগল?"
"ভালই! বেশ উন্নতমানের। আর এডজাস্ট করার ফিচারটি আমার অনেক পছন্দ হয়েছে।"
"তোমার পায়ের উঁচু-নিচু গঠনের জন্যই এটা নিয়েছিলাম।"
"কত্ত খেয়াল রাখো আমার! কিন্তু আমি এটা ব্যবহার করবো না।"
"কেন? কি সমস্যা এটায়?"
"এটায় কোন সমস্যা নেই। সমস্যাটা মূলত আমার।"
"কি সমস্যা তোমার?"
"দেখো, ব্যাপারটা একটু জটিল হলেও, সহজ ভাষায় বলতে গেলে; এটা আমার জন্য লজ্জাজনক একটি বস্তু।"
"সেটা কিভাবে?"
"দেখো, আমি বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে গিয়ে বক্তৃতা দিয়ে থাকি। আমাকে ডাকার মূল কারণটাই হচ্ছে গিয়ে; আমি হাঁটতে অক্ষম, কিন্তু কথায় আমার দম। অচল হলেও, অসীম মর্যাদার অধিকারী। আমি এই হুইলচেয়ারের সাহায্য ছাড়া নিজের রুমেও প্রবেশ করতে পারি না, কিন্তু আমার সাহায্য নিয়ে অনেকে কারাগার থেকে বের হবার সুযোগ পেয়ে থাকে। এগুলো হলো এখনকার বিশেষ একটি চলমান ট্রেন্ড। আমাকে দেখে অসংখ্য মানুষ অনুপ্রেরণা পেয়ে থাকে। আমার দেহের নিচ থেকে এই হুইলচেয়ার সরিয়ে ফেললে, আমার পরিচয়ের একটি ক্ষুদ্র এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই আমি নিজের সামান্য মানসিক তৃপ্তির উদ্দেশ্যে, অসংখ্য অসংখ্য মানুষের কাছে নিজের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে রাজি নই।"



"অসংখ্য অসংখ্য অজানা লোকের কথা চিন্তা করে শুধু নিজের নয়, আমার ইচ্ছাকেও মাটি দিচ্ছ।"
"তোমার ইচ্ছাকে শ্রদ্ধা করি বলেই এটা ট্রায়াল দিয়ে দেখেছিলাম। এবার তোমাকে অনুরোধ করছি আমার ইচ্ছাকেও শ্রদ্ধা জানানোর জন্য।"
"বাহ্! অনেক সুন্দর একটু উত্তর তো! এত সুন্দর উত্তর কোথা থেকে শিখলে? আমিও শিখতে চাই।"
"হা হা হা! শিষ্যকে স্য়ং গুরুই প্রশ্ন করছে! মজা পেলাম।"
"মজা তো পাবেই! তোমার কাছ থেকে আর কি আশা করা যায়?"
"আশা করার কোনো সীমাবদ্ধতা আছে নাকি? আমিও তো তোমাকে নিয়ে কত আশা প্রত্যাশা করেছিলাম, তার সবই কি পূরণ হয়েছে? সেগুলোর কোনোটাই তো পূরণ হয়নি।"
"পূরণ হবে কি করে? তোমার অহংকার তো আর কমার নাম নেয় না।"
"আমার অহংকার!"
"জি!"
"তোমার বাবার দুর্ব্যবহার ভুলে গিয়েছ বোধহয়। একটু স্মরণ করিয়ে দিই?"
"কোন দুর্ব্যবহারের কথা বলছো তুমি?"
"আমাকে প্রথম দেখাতেই তোমার দিকে ঘুরে অসন্তুষ্ট দৃষ্টিতে তাকানো, নাক সিটকানো, কথায় কথায় ঘরের চারপাশে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকানো। এগুলো কি শিষ্টাচার? আমাকে তো উনি মানুষ হিসেবে গণ্য করতেই রাজি না। এমন লোকের সঙ্গে কীভাবে ভাল আচরণ করা যায়?"
"উনি দেশের সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রাপ্ত একজন রিটায়ার্ড কর্নেল হয়েও, একমাত্র আমার অনুরোধে তোমার বাসায় প্রস্তাব নিয়ে আসলেন। তাও উনার ছোটখাটো কথাগুলো এভাবে ধরলে?"
"উনার চেয়ে বেশি মর্যাদা তো এখন আমারই। কিন্তু আমি তো এসব বৈষম্য থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছি। আমি তো মানুষের বাসায় গেলে এমন উদ্ভট আচরণ করি না।"
"তোমার এই মন-মানসিকতার জন্যই আজ আমাকে একজন এমন লোকের সঙ্গে সংসার করতে হচ্ছে, যে থাকেও দেশের বাহিরে, আর ফিরলেও সারাদিন-সারারাত বাহিরে কাঁটায়।"



"রাতটা কোথায় কাঁটায়? জুয়ার আড্ডায়? মদের আড্ডায়? নাকি পতিতালয়ে?"
"সে যেখানে খুশি সময় কাঁটাক! এতে আমার কিছু যায়-আসে না।"
"স্বামী তোমার, আর তোমারই কিছু যায়-আসে না? অদ্ভুত তো!"
"কিছু তো আর করার নেই। একা একাই রাত্রি যাপন করতে হয়।"
"সেই রাত্রিগুলো আমার সাথেই কাটাতে পারো। আমি তো তোমার জন্যই আছি।"
"তোমার মাথায় কি সারাটা দিন এসব ঘুরে?"
"মানে কি? তুমি তোমার সমস্যা আমার কাছে বললা আর আমি তার সমাধান বললাম। আমার এইসব পরামর্শের জন্য তো আমি অন্যদের কাছে টাকা চার্জ করি। ফ্রিতে পাচ্ছ বলে দাম দিচ্ছ না!"
"দাম কি শুধু তোমার পরামর্শের রয়েছে? আমার দেহের, আমার ভাবনার কোনো দাম নেই?"
"দাম আছে বলেই তো মূল্যায়ন করতে চাই।"
"এভাবে তুচ্ছ করে, যৌন হয়রানিমূলক কথাবার্তা বলে, মনের ভাব নিয়ে হাসিঠাট্টা করে মূল্যায়ন করতে চাচ্ছিলে?"
"বহুবছর আগেই এগুলো বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তখন তোমার মাথায় সংসার করার ভূত চড়ে ছিল। তখন তো আদর্শ স্ত্রী হবার কথা বলেছিলে। সেগুলি আজ মনে করাচ্ছি তোমাকে বোঝানোর জন্য, তখন আমার মনটা কেমন করছিল।"
"তখন আমার আর কি করার ছিল, বলো? আমার পরিবার তো মোটেই রাজি ছিল না।"
"তোমার গর্ভে আমার সন্তান থাকলে তারা সবাই রাজি হতে বাধ্য হতো।"
"এসব নোংরা কথা ছাড়া অন্য কিছু বলার থাকলে বলো।"
"এতে নোংরামি কীসের? তুমি কি জন্মগ্রহণ করোনি? তোমার দুনিয়াতে আসায় কি তোমার মা নোংরা হয়ে গিয়েছিল?"
"আমার মা এসব বিয়ের পর করেছিল।"
"এটার আদৌ কোনো প্রমাণ রয়েছে তোমার কাছে? কোনো প্রমাণ আছে তোমার মায়ের কুমারীত্বের? কোনো দলিলপত্র, কোনো প্রমাণপত্র, কোনো ডাক্তারের মেডিক্যাল রিপোর্ট?"
"সেই একই যুক্তি তোমার মায়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।"
"আমি তো এমন কোনো দাবি করিনি।"
"এমন দাবি তো আমিও করিনি।"
"কুমারীত্বর দাবি কি আমার ছিল?"
"আমার মানে ছিল; বিয়ের পূর্বে এসবকে নোংরামিই বলা হয়।"
"সেক্ষেত্রে আমিও তো বলতে পারি; আমরা একটা কাজী অফিসে গিয়ে, পালিয়ে বিয়ে করে, এসব করতে পারতাম।"
"সেসময় তো পালিয়ে বিয়ে করার কোনো আগ্রহ পোষণ করোনি! হঠাৎ কেন?"



"সেসময়ও আমার মাথায় এটা ছিল, কিন্তু তুমি যখন ফোনে কেঁদে কেঁদে বলছিলে যে কোনোভাবেই কিছু সম্ভব না, কিছুই করার নেই, সবই শেষ হয়ে গিয়েছে, তোমাকে ভুলে যেতে; আর কি কি হাবিজাবি, তখন আমার মাথাও গরম হয়ে গিয়েছিল। তখন তো তোমার মুখ দেখবার জন্য প্রতিই রুচি চলে গিয়েছিল, ভালবাসা তো অনেক দূরের কথা। আমি মনে করেছিলাম অনেক বুঝে-শুনে সিদ্ধান্ত নিয়েছ, তাই আর জোরপূর্বক কিছু করাতে চাইনি।"
"বাদ দাও। এখন এসব কথার কোনো লাভ নেই।"
"লাভ আছে কি না, সেটা যদি বোঝার মতো জ্ঞান যদি তোমার থাকতো, তাহলে আজ এই দিন দেখতে হতো না আমাদের। এভাবে রিপোর্ট নেওয়ার বাহানা করে ঘর থেকে বের হওয়া, আমার সঙ্গে এসে এই সামান্য কিছু সময় কাটানো, প্রতিটা রাত এই কষ্টে শুয়ে থাকা।"
"তাহলে তুমিই বলো এটার কি সমাধান রয়েছে? সেও আমাকে তালাক দিচ্ছে না, আর আমিও তার সম্মতি ছাড়া তালাক নিতে পারব না। সে বিদেশে কার কার সাথে কি কি করে বেড়ায় আর এখানে এসে দিনরাত কোথায় থাকে, সেসব নিয়ে আমার হাতে কোনো মজবুত প্রমাণও নেই। তাহলে কীভাবে কি করবো উকিল সাহেব? বলুন! একজন মক্কেল হিসেবে প্রশ্ন করছি আপনাকে। বলুন!"
"যদি মক্কেল হিসেবে প্রশ্নটা করে থাকেন, সেটার মূল্য অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। তা কি পারবেন?"
"আপনার সেবার মূল্যটুকু বলুন। সাধ্যে থাকলে অবশ্যই পারব।"
"সেক্ষেত্রে কাছে আসতে লাগবে।"
"জি, এতটা কাছে ঠিক আছে?"
"আরেকটু কাছে।"
"জি, এবার ঠিক আছে?"
"হ্যাঁ! এবার আমার কৃষ্ণবর্ণ গালে আপনার গোলাপি ঠোঁটের দ্বারা একটা ছাপ বসিয়ে দিন।"
"একটু বেশিই চড়া দাম চেয়ে বসলেন না?"
"এই দাম ছাড়া আমার সেবা প্রদান করা সম্ভব না।"
"তাহলে থাক, বাবা! অন্যথায় গিয়ে দেখতে হবে তাহলে।"
"আরে মিস, কোথায় যাচ্ছেন? আপনার পরামর্শ তো নিয়ে যান!"
"কমে দিলে দেন, নাহলে যাই।"
"ঠিক আছে, বাবা! ঠিক আছে! ইশশ! এত্ত ড্রামা!"
"এবার আসল কথায় আসি। কিছু করা যাবে এক্ষেত্রে?"

১০



"তাকে খুন করা যেতো, কিন্তু তার ঠিক পরপর তোমাকে বিয়ে করলে আমরা সন্দেহের শিকার হতাম। আবার তাকে কোনো কেসে ফাঁসিয়ে, জোর করে তালাক দেওয়ানো যেতো, তবে সে মুখ খুললেই আমরা ধরা। নারী নির্যাতনের মিথ্যা মামলা দিতে পারো, কিন্তু সেটা প্রমাণের জন্য তোমার দেহে আঘাতের দাগ লাগবে, সেগুলো আবার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখবে, নির্যাতনের কারণও তেমন একটা দিতে পারবে না, তারপর তদন্ত করলে তো শেষমেশ আমার উপরেই সন্দেহ আসবে।"
"তাহলে কি কোনো উপায় নেই?"
"একটা উপায় রয়েছে!"
"কি?"
"সে যদি অন্য কারো সঙ্গে ব্যভিচার করতে হাতেনাতে ধরা পড়ে যায়, তাহলে।"
"সেটা কে করবে?"
"আমার পরিচিত একজন এই কাজটা করতে পারে।"
"তাহলে, তাড়াতাড়ি এটার ব্যবস্থা নাও।"
"কিন্তু তার আগে আমার কিছু শর্ত রয়েছে।"
"কেমন শর্ত?"
"তুমি যে আমাকে ধোঁকা দিয়ে যাবে না, সেটার প্রমাণ চাই।"
"তা কীভাবে প্রমাণ করব? একটা কাগজে লিখে, সেটায় স্বাক্ষর করে দিব?
"আরে, না! না! কি বলছ? তোমার মতো একজন অতি ভদ্র নারীর জন্য সবচেয়ে বড় প্রমাণপত্র হবে তোমার এই দেহ। একটা রাতের বিনিময় তোমায় চিরকালের জন্য মুক্ত করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিব।"
"পাগল হয়ে গিয়েছ তুমি? আমার পক্ষে এসব সম্ভব না। যদি আমাকে প্রকৃতপক্ষে ভালবেসে থাক, তাহলে এমন বায়না আর ধরবে না।"
"কেনো গো? তোমার কষ্ট দূর করার জন্যই তো এই আয়োজন। তোমার তালাক হয়ে গেলে তো আমরা একত্রিত হয়ে পড়বই। তাহলে দ্বিধা কীসের?"
"একজন পুরুষ এবং মহিলার মাঝে মিলন ছাড়াও একটা বন্ধন থাকে, তার নামই ভালবাসা।"
"বাহ্! চমৎকার তো! কোন সিনেমার ডায়লগ এটা?"
"যা সত্য, তা-ই বলছি।"
"তাহলে কি তুমি বলতে চাও; শারীরিক মিলন মিলন ভালবাসার কার্যকলাপের বহির্ভূত? এটি কি সম্পূর্ণরূপে একটি পৃথক সত্তা?"

১১


"অবশ্যই! কেন, ভালবাসা কি শারীরিক মিলন ছাড়া সম্ভব না?"
"সম্ভব, কিন্তু পুরোপুরি না।"
"কেন? এর এমন কি দরকার?"
"সেটা বুঝতে হলে তোমার একটি উদাহরণের প্রয়োজন। দাঁড়াও! একটি উদাহরণের ব্যবস্থা করছি। এই রাফি! এই রাফি!"
অ্যাডভোকেট সাহেবের ডাক শুনার সঙ্গে সঙ্গে গ্লাস জায়গামতো রেখে দিয়ে, আস্তে আস্তে হেঁটে, নিজের রুমে গিয়ে, সেখান থেকে উনার রুমে গিয়ে হাজির হলাম। এভাবে করে গেলাম যাতে সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছানোর জন্য সন্দেহ করতে পারতেন। কিন্তু রুম থেকে হেঁটে আসার সময়ের কারণে এই সন্দেহ এড়াতে সক্ষম হলাম। রুমে প্রবেশ করার পরে এডভোকেট সাহেব আমাকে বললেন , "তিনটা ম্যাচ এর বাক্স এবং এক গ্লাস পানি নিয়ে আসো। "
আমি কিছু না বলেই , চুপচাপ গিয়ে তিনটি ম্যাচ এর বাক্স আর এক গ্লাস পানি  নিয়ে আসলাম। তা রেখে আবার পূর্বের মতো দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে, চলে যাবার ভান করলাম। কিন্তু এবার আমার কৌতহল ছিল দ্বিগুণ। কেননা এবার অ্যাডভোকেট সাহেব খুবই রসাত্মক এবং আকর্ষণীয় একটি বিষয়ে উদাহরণ দিতে যাচ্ছিলেন। এ দৃশ্য তো কোনোমতেই না দেখে থাকা যাবে না।

১২


আমি আবার আস্তে করে দরজার বাহিরে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। উনাদের আলাপ শোনার পাশাপাশি কিছু গোপন দৃশ্য দেখার আশায় দরজার চাবির ছিদ্রের ফাঁকে, বাম চোখ রেখে সব দেখছিলাম।
দেখতে পাচ্ছিলাম;
অ্যাডভোকেট সাহেব ম্যাচের বাক্সগুলো টেবিলের উপর এমনভাবে সাজিয়ে রেখেছেন, যে তার মধ্যে মাঝের বাক্সটা উনার কাছের দিকে এবং অবশিষ্ট দুটো বাক্স ম্যাডামের কাছের দিকে। তাছাড়া পানির গ্লাসটি অ্যাডভোকেট সাহেবের হাতের ডান পাশে রাখা; ঠিক সেই অবস্থায়, যে অবস্থায় তা রেখেছিলাম। অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব নিজের হাতের ডান পাশের ম্যাচের বাক্সটা হাতে নিয়ে তার ভিতরের কাঠিগুলো বেড় করে, সবগুলো কাঠি মুঠোয় নিয়ে, কাঠির মুখের অংশটুকু গ্লাসে দুবোলেন, কিন্তু অবশিষ্ট অংশটুকু শুকনো রেখেই গ্লাস থেকে উঠিয়ে ফেললেন। কাঠিগুলো বেড় করে, টেবিলে রেখে ম্যাডামের কাছে প্রশ্ন করলেন, "আচ্ছা বলতো, এই কাঠিগুলো এই বাক্সের পাশে ঘষলে কি আগুন জ্বলবে?"
তার উত্তরে ম্যাডাম বললেন, "এ কি ধরনের প্রশ্ন? ভিজা কাঠি দিয়ে কি আগুন জ্বলবে কখনও?"
"জ্বলবে না কেন?"
"কারণ ভিজা কাঠি তো আগুন জ্বালাতে অক্ষম।"
"এই তো! এবার এসেছ মূল কথায়। আচ্ছা এখন বলতো, এই বাক্সের পাশে যদি শুকনো কাঠি দিয়ে ঘষা দিই, তাহলে কি এটা জ্বলবে?"
"হ্যাঁ! অবশ্যই!"
"কেন?"
"কারণ সেটা আগুন জ্বালানোর জন্য উপযুক্ত।"
"ভেরি গুড! এ গেলো প্রথম উদাহরণ। এবার দ্বিতীয়টি।" বলেই অ্যাডভোকেট সাহেব নিজের হাতের বাম পাশের ম্যাচের বাক্সটা হাতে নিয়ে, গ্লাসের মধ্যে নিজের ডান হাতের আঙ্গুল ভিজিয়ে, সেই ভিজা আঙ্গুলটা সেই বাক্সের দুপাশে ঘষে, ভিজিয়ে নিলেন। অতঃপর সেই বাক্স থেকেই একটা কাঠি বেড় করে, বাক্স এবং কাঠি উভয়ই দিলেন ম্যাডামের কাছে। ম্যাডামের কাছে তা দিয়ে বললেন, "এই বাক্সের পাশে ঘষা দিয়ে আগুন জ্বালানো যাবে?"
উত্তরে ম্যাডাম বললেন, "না! কারণ এবার বাক্সটাই অক্ষম।"
"সাব্বাশ! এবার তৃতীয় উদাহরণে যাওয়ার পূর্বে একটা ছোট্ট প্রশ্ন করবো।"
"হ্যাঁ, বলো।"
"দুটো ম্যাচের বাক্স এবং কাঠি একই ধরনের হবার সত্ত্বেও, এদের অক্ষম হবার কারণ ভিন্ন হলো কেন? অর্থাৎ, উভয় পক্ষের লক্ষ্য যদি একই হয়ে থাকে, তবে এদের ব্যর্থতার কারণ ভিন্ন কেন?"
"কারণ তাদের উভয়কেই সফল হতে একে অপরের সহায়তার প্রয়োজন এবং উভয়পক্ষকে অবশ্যই সমানভাবে সক্ষম হতে হবে। কেবল একটিমাত্র পক্ষও যদি অক্ষম হয়ে থাকে, তবে তার প্রভাব পড়বে উভয়ের কার্যকারিতার উপর।"

১৩


অ্যাডভোকেট সাহেব একটা ছোট্ট হাততালি দিয়ে বললেন, "বাহ্! এত সুন্দর করে তো আমিও বিশ্লেষণ করতে পারতাম না। অসাধারণ হয়েছে। চলো, এবার তৃতীয় উদাহরণের দিকে আসি।" বলেই উনি নিজের দেহের নিকটবর্তী ম্যাচের বাক্সটা হাতে নিয়ে, তার একটা কাঠি বেড় করে, সেই বাক্সের পাশে ঘষা দিয়ে, আগুন ধরিয়ে, তা ধরে রেখেছিলেন। কাঠিটা উনার হাতেই ছিল যখন পর্যন্তনা; সেই জ্বলন্ত কাঠিটি পুড়তে পুড়তে, নিজের দুই তৃতীয়াংশ সম্পূর্ণভাবে পুড়িয়ে, নিজে নিজেই নিভে যায়। অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব বললেন, "কিছু খেয়াল করেছ?"
কিছুটা চমকে উঠে ম্যাডাম জিজ্ঞাস করলেন, "কি?"
"এই আগুনটা হলো প্রেম, কাঠি এবং বাক্স হলো দেহ, পুড়ে যাওয়া অংশটুকু হলো প্রেমের গভীরতা এবং ধোঁয়া হয়ে উড়ে যাওয়া অংশটুকু হলো দূরত্ব। দাম্পত্য জীবন নামক মাটিতে, প্রেম নামক বীজ রোপণ করার প্রক্রিয়া হলো এই শারীরিক মিলন। এবার বুঝতে পেরেছ ব্যাপারটা?"
"হুম! তবে আমার একটা জটিল প্রশ্ন রয়েছে। তার উত্তর দিতে পারলে মেনে যাবো।"
"হ্যাঁ, বলো! বলো!"
"বিয়ের রাত তো আমার স্বামীর সঙ্গে আমার সেই মিলন ঘটেছিল, তাহলে আমি কেন তাকে ভালবাসি না?"
"তুমি তো বলছিলা; প্রশ্নটা জটিল হবে। কিন্তু এ তো খুবই সহজ একটা প্রশ্ন।" এটা বলে অ্যাডভোকেট সাহেব এবার পুরোপুরি শুকনো এবং সক্ষম বাক্সটি থেকে একটা কাঠি বেড় করে, তার মুখের অংশটুকু নিজের ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে ধরে, উল্টো করে, কাঠির শরীরটা গ্লাসের ভিতরে দিয়ে, ভিজিয়ে নিলেন। তবে এবার কাঠির মুখখানা শুকনো রেখে দিলেন। সেই কাঠিটা নিজের বাম হাতে, সোজা করে ধরলেন। ম্যাচের বাক্সটা ডান হাতে নিয়ে, তার পাশে সেই কাঠির মুখ ঘষে, আগুন ধরালেন। আগুনটা গতবারের কাঠির মতো নিজের আগুন কাঠিটার দুই তৃতীয়াংশ জ্বালাতে পারল না। আগুন নেভার পরে অ্যাডভোকেট সাহেব সেই কাঠি দিলেন ম্যাডামের হাতে। কাঠিটা উনার হাতে দিয়ে বললেন, "এবার দেখো; কাঠিটা জ্বলেছে ঠিকই, কিন্তু নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। বলতো, সেটা কেন হলো? কেন বাকি অংশটুকু কেন পুড়েনি?"
"কারণ এবার পুরোপুরি অক্ষমতা না থাকলেও, আংশিক ত্রুটি ছিল।"
"আংশিক ত্রুটি কি করে? উভয়পক্ষই নিজ নিজ ভূমিকা পালন করল, ঘষা লাগার পর আগুনও ধরল, কোনো রকমের বাধাও ছিল না। আংশিক ত্রুটি আবার কোথায় পেলে?"
"কাঠির দেহটা আগুন দ্বারা পুরোপুরি পুড়তে পারেনি। কারণ কাঠির দেহ ছিল ভিজা, যা তার কার্যকারিতায় কোনো বাধা না সৃষ্টি করলেও, একটা ছোটখাটো সমস্যার সৃষ্টি করেছে। কাঠির অবশিষ্ট অংশটুকু আগুনের স্পর্শ হতে বঞ্চিত থাকল এই পানির কারণে। তাই কোনো প্রকার ত্রুটি না থাকা সত্ত্বেও তার একদিক দিয়ে দুর্বলতা বিদ্যমান ছিল।"
"অসাধারণ! চমৎকার উপস্থাপনা! এবার একটা জিনিস খেয়াল করো; তুমি সেই একটি রাতের বিনিময়ে অসংখ্য রাতের কর্মফল আশা করছো। তাহলে তুমিই এবার বলো; সেই একবারের পর আর কখনওই তার স্পর্শ না পাওয়া কি সেই আংশিক অক্ষমতা নয়?"


১৪


অ্যাডভোকেট সাহেবের উত্তরটা শোনার পর, ম্যাডামের চেহারায় আশ্চর্য ভাবটিকে দেখে, যে কেউই খুব সহজেই উপলব্ধি করতে পারবে যে উনার প্রশ্নের সন্তোষজনক একটি উত্তর দেয়া হয়েছে। অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব আরো বললেন, "তবে এখানে তোমাদের উভয়ের মধ্যে কারও সম্মতি বা রুচি না থাকার ফলে, এখন জোর করে মিলন করলেও কাজ হবে না। কারণ যদি আদৌ তোমাদের মনে ভালবাসা উৎপাদিত হবার ছিল, তা এত বছরে নিজ থেকেই হয়ে যেত। না সে থাকতে পারত তোমার স্পর্শ না পেয়ে, আর না তুমি থাকতে পারতে তার স্পর্শ ছাড়া। এখন চেষ্টা করেও কিছু করা সম্ভব না। আলাদা হয়ে, নিজ নিজ সঙ্গী খুঁজে বেড় করো।"
কথাটি শুনে হঠাৎ চমকে উঠে ম্যাডাম বললেন, "খুঁজে বেড় করো মানে?"
"মানে, হতে পারে সেই সঙ্গী নই, বরং অন্য কেউও তো হতে পারে, তাই না?"
"এতক্ষণ এত কিছু বলার পর একথা বলছো? আগে বললেই তো পারতে। আমাদের দুজনের সময়ই বেঁচে যেত।" বলে অ্যাডভোকেট সাহেবের মূখের দিক থেকে দৃষ্টি চাপিয়ে, বাম দিকে মুখ করে নিলেন। এ দৃশ্য দেখে অ্যাডভোকেট সাহেবের চেহারায় হাসি ফুটে উঠল। দেখে মনে হচ্ছিল, উনি ম্যাডামের রাগ দেখে খুবই খুশি। যেমন কোনো বিশেষ প্রকারের সংকোচ দূর হয়ে এবার সন্তুষ্টি পেলেন। তবে সেই হাসিটার রহস্য কিছুক্ষণের মধ্যে বুঝতে পেলাম যখন অ্যাডভোকেট সাহেব বললেন, "খুবই ভাল লাগল তোমার এই প্রতিক্রিয়া দেখে।"
এ কথা শুনে, ম্যাডাম আশ্চর্য হয়ে, উনার দিকে ঘুরে, জিজ্ঞাস করলেন, "এ কি বোকছো? মাথা ঠিক আছে তো? চায়ের মধ্যে কিছু মেশানো ছিল না তো আবার?"
"না গো! আমি ঠিকই আছি।"
"তাহলে এসব কি বলছ হঠাৎ? কি প্রতিক্রিয়া দেখে ভাল লাগল?"
"তুমি যেভাবে ব্যাপারটা হজম করতে পারলে না, রাগ করে বলে; খুবই ভাল লাগল আমার কাছে।"
"কেন? এতে ভাল লাগার কি আছে?"
"তোমাকে অন্য কাউকে খুঁজতে বলাটা তোমার এক মুহূর্তের জন্যও সহ্য হয়নি। এটাই সেই ভালবাসা যার জন্য আমি এত বছর ধরে অপেক্ষায় রয়েছি। আমাদের মাঝে তো এই অনুভূতি শুরু থেকেই বিদ্যমান যা তোমার সঙ্গে মিলনের মাধ্যমেই নিজের সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছাতে পারবে।"

১৫



এমনই সময় হঠাৎ করে ম্যাডামের ব্যাগের ভিতর থেকে ফোনের এলার্মের শব্দ বেজে উঠল। উনি ফোনটা বেড় করে এলার্মটা বন্ধ করে, ব্যাগে আবার রেখে, উঠে দাড়িয়ে পড়লেন। এ দৃশ্য দেখে আমি দ্রুত পালাতে নিবো আর এমতাবস্থায় দেখি; অ্যাডভোকেট সাহেব ম্যাডামের বাম হাত নিজ বাম দিয়ে ধরে, নিজের দিকে টেনে আনলেন। এরপর নিজের ডান হাতটা দিয়ে উনার গলা চেপে ধরলেন। গলা চেপে ধরলেন বেশ মজবুতভাবে, তবে কণ্ঠনালীতে কোনো ধরনের জোর প্রয়োগ করছিলেন না। দৃশ্যটা দেখে এক মুহূর্তের জন্য আমার মাথা থেকে পালানোর চিন্তা গায়েব হয়ে গেল। আমি সেই মুহুর্তে একজন বড়মাপের দর্শকের মতো শুধু কৌতূহলের সঙ্গে দেখেই যাচ্ছিলাম। পালিয়ে যাওয়ার ভয় আমার মন ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। এই দৃঢ় কৌতূহলের সঙ্গে দেখলাম; অ্যাডভোকেট সাহেব ম্যাডামের গলা ধরে উনাকে আরো নিজের আরো কাছে টানছিলেন। একেবারে যখন ম্যাডামের ঠোঁটখানা অ্যাডভোকেট সাহেবের ঠোঁটের কাছে এসে পড়ে, তখন উনি থেমে গিয়ে বলেন, "ওঠার পূর্বে অনুমতি প্রার্থনা করা হল এক প্রকারের শিষ্টাচার। তোমার অতি ভদ্র কর্নেল বাপজান তোমাকে এই শিক্ষা দিয়েছেন?"

১৬


ম্যাডাম নিজের ডান হাত দিয়ে অ্যাডভোকেট সাহেবের ডান হাতটা নিজের গলা থেকে সরানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু একটা চিৎকারও দেননি। উনার জায়গায় অন্য কোনো মহিলা হলে এতক্ষণে চিৎকার মারতো অন্তত পাঁচ-ছয়বার। কিন্তু উনি এমন অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও একফোঁটা শব্দও করেননি। উনার ঠিক সেভাবেই অ্যাডভোকেট সাহেবের চোখের মধ্যে ডুবেছিল, যেভাবে শুরু থেকেই দেখে আসছি। অবাক হলাম যখন ম্যাডামের মুখে একটা মুচকি হাসি ফুটে উঠল। সেই মুহুর্তে ম্যাডাম অ্যাডভোকেট সাহেবের ডান হাত নিজের উভয় হাত দিয়ে ধরে জিজ্ঞাস করলেন, "এবার আসি?" তা দেখে অ্যাডভোকেট সাহেবও একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, "এবার যেতে পারো।" বলার সাথেসাথে ম্যাডামের গলা ছেড়ে আরো বললেন, "তোমার অপেক্ষায় থাকবো।" অতঃপর ম্যাডাম দরজার দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। তা দেখে, আমি দ্রুত আস্তে আস্তে হেঁটে, রান্নাঘরে ঢুকে, পানির গ্লাসে পানি ঢেলে, হাতে নিয়ে রাখলাম। ম্যাডাম রুম থেকে বের হবার পর আমি উনাকে দেখে পানি পান করতে লাগলাম। এবার ম্যাডাম আমার দিকে তাকিয়ে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেও কোনো প্রকার প্রশ্ন করেননি। বাহিরে বের হবার জন্য অগ্রসর হতেই, পেছন থেকে অ্যাডভোকেট সাহেব বললেন, "বৃষ্টি! বাসায় গিয়ে আমাকে সব তথ্য পাঠিয়ে দিও। আর হ্যাঁ! আমি ইন্টারভিউটা ইমেইলে পাঠিয়ে দিয়েছি।" তার উত্তরে ম্যাডাম বললেন, "ঠিক আছে। নিজের খেয়াল রেখ।" দরজা খুলতে খুলতে বললেন, "গেলাম এবার। আল্লাহ্ হাফেজ।" জবাবে অ্যাডভোকেট সাহেব বললেন, "সাবধানে যেও। আল্লাহ্ হাফেজ।"

0 Reviews:

Post Your Review