ভয়ানক হাসি
পরের দিন সকালে অ্যাডভোকেট সাহেব তাদেরকে ফোন করে কবরস্থানের ঠিকানা জানিয়ে দিলেন এবং ছেলেটিকে একা পাঠাতে বললেন। আমরা দুপুরে ঠিক দুটার দিকে সেখানে অপেক্ষায়, কবরস্থানের ভেতরে দাড়িয়ে ছিলাম। অ্যাডভোকেট সাহেবের বাবার কবরের পাশেই দাড়িয়ে ছিলাম। খেয়াল করলাম ছয়টি বড় বড় গাছ কবরটিকে ছায়া দিচ্ছে। বেশ দারুণ একটি স্থানে ভদ্রলোকটিকে দাফন দেয়া হয়েছে। আশেপাশে মানুষ খুবই কম ছিল। হাতেগোনা কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছিল। অ্যাডভোকেট সাহেবের বাবার কবরটা খুবই ভিতরের দিকে অবস্থিত। এত নিরিবিলি জায়গায় কেউ মরে পড়ে থাকলেও কেউ দেখতে আসবে না। কারণ জায়গাটা ভীষণ বড় এবং আশেপাশে কোনো ঘরবাড়ি নেই। এসব জায়গায় সহজেই চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই হওয়ার প্রবণতা থাকে। কিন্তু সবচেয়ে অবাক করার মতো ব্যাপার ছিল, যেখানে অ্যাডভোকেট সাহেবের বাবার কবরের পাশেই আরেকটা কবর খুদে রাখা। আমি এর সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞাস করব আর এতক্ষণে সেই চামচা প্রকৃতির লোকটা এসে হাজির হলো।
২
"অপেক্ষার জন্য অত্যন্ত দুঃখিত, উকিল সাহেব। রাস্তাঘাটে যেই জেম! তার উপর দিয়ে এখানে এসে শেষ মাথা খুঁজছিলাম। সরি! সরি!" সেই লোকটি বললো।
"আরে! কোনো ব্যাপার না। ইটস ওঁকে!" বলে অ্যাডভোকেট সাহেব নিজের বাবার কবরের তরফ ইশারা করে বললেন, "এই হলেন আমার বাবা; মোঃ সিবলি ক্বারি। এনার কাছে ক্ষমা চাও।"
"জি, অবশ্যই।" বলে কবরের দিকে ঘুরে, হাত জোড় করে বলতে লাগল, "আমি অতিরিক্ত রাগের মাথায় আপনার ছেলেকে গালি দিতে গিয়ে ভুলবশত আপনাকেও গালি দিয়ে ফেলেছিলাম। আপনি পরকাল থেকে আমার ডাক শুনে থাকলে, আপনার কাছে অনুরোধ করছি, দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।" এটা বলা শেষ হবার সাথেসাথে অ্যাডভোকেট সাহেব উনার বন্দুকটি বের করে, সেই লোকটার দু পায়ের হাঁটুর মধ্যে গুলি করলেন। লোকটা সঙ্গেসঙ্গে মাটিতে পড়ে গেল। এই দৃশ্যটি দেখে আমি চমকিত হয়ে পিছনে চেপে গেলাম। অতঃপর আশেপাশের যারা ছিল, তারা দৌড় দিয়ে আসলো। প্রথমে মনে করেছিলাম তারা অ্যাডভোকেট সাহেবকে থামাতে আসছে, কিন্তু না, তারা এসেছিল সেই চামচাকে ধরে রাখতে। তারা সবাই মিলে সেই চামচা প্রকৃতির লোককে ধরে মাটিতে শুয়িয়ে রেখেছিল।
৩
অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব তার হুইলচেয়ার নিয়ে লোকটার গলায় চড়িয়ে দিলেন। হুইলচেয়ার এবং তার উপর বসে থাকা অ্যাডভোকেট সাহেবের পুরো ভাড়টা ছিল লোকটার গলার উপরে। লোকটার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এমতাবস্থায় সে একটি পানে থেকে বের হওয়া মাছের মতো ছটফট করতে লাগল। দম বের হতে তাড়াতাড়ি করতে, অ্যাডভোকেট সাহেব হুইলচেয়ার আগে-পিছনে করছিলেন। লোকটা অনেকক্ষণ নাড়াচাড়া করার পর শেষমেশ মারা গেল। পাশের সেই খালি কবরটির ব্যাপারটা তখন বুঝতে পারলাম। লোকটিকে মেরে ফেলার পরে বাকিরা তার লাশ সেখানে ফেলে দিল। গর্তের মধ্যে কিছু শুকনো পাতাও ফেলে, তার উপর কেরোসিন ঢেলে দিল। অতঃপর একটা ম্যাচের কাঠি ধরিয়ে সেখানে ফেলে দিল। লাশটি পুড়তে প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় লাগল। এই সময়টুকুর মধ্যে আরো কয়েকবার কেরোসিন ঢালা হলো। পুরোভাগে পোড়ানোর পরে তার উপর মাটি দিয়ে দিল। দৃশ্যটি দেখে অ্যাডভোকেট সাহেবের চেহারায় মুচকি হাসি দেখতে পাচ্ছিলাম। অ্যাডভোকেট সাহেবের মুখে সেই হাসিটা দেখে সেদিন ভীষণ ভয় পেলাম। সব শেষে তারা সবকিছু গুছিয়ে রেখে দিল। সবাই কলের পানি দিয়ে নিজের শরীর থেকে রক্ত পরিষ্কার করে নিল। আমি নিজ হাতে অ্যাডভোকেট সাহেবের হুইলচেয়ার এবং কাপড়ে লাগা রক্তের দাগ ধুয়ে দিলাম।
৪
রক্তের দাগ ধোয়ার সময় উনি আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, "আশা করি মুখটা পরবর্তীতেও এভাবেই বন্ধ থাকবে।" হঠাৎ উনার এই কথা শুনে চমকে জিজ্ঞাস করলাম, "জি! আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। মুখ বন্ধ বলতে?"
"থাক্! আপাতত বাসায় চলো। মাথায় এখন অনেক কিছু ঘুরছে তো। এখন সোজা কথাও বাকা মনে হবে। তার তুলনায় আমার কথা তো এমনিতেই বাকা।"
কিছু না বুঝেই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালাম। অতঃপর অ্যাডভোকেট সাহেব ড্রাইভারকে ফোন করে গাড়ি ডাকালেন এবং আমরা বাসার জন্য বের হলাম। গাড়িতে বসে পুরোটা সময় শুধু সেই হত্যার ব্যাপারেই ভাবছিলাম। চোখের সামনে সেই দৃশ্যগুলি ভাসছিল। কিভাবে লোকটা ছটফট করছিল, কিভাবে তার নাক-মুখ থেকে রক্ত বের হচ্ছিল, কিভাবে তাকে সবাই ধরে রেখেছিল- ওগুলোই বারবার মনে পড়ছিল। ঐ একজন লোক তো তার চোখের মধ্যে নিজের হাতের আঙ্গুলগুলো ঢুকিয়ে দিয়েছিল। জানি, সেই লোকটাও একটা খুনি, তাও এমন নির্মমভাবে কারো হত্যা নিজের বিবেককে স্বাভাবিক রাখা যায় না। এই ব্যাপারে অবশ্যই গুরুতর অনেক কথাই ছিল অ্যাডভোকেট সাহেবের সঙ্গে। এটা চিন্তা করতে করতে আমরা বাসায় পৌছে গেলাম। বাসায় প্রবেশ করতেই না করতে অ্যাডভোকেট সাহেবের ফোন বেজে উঠলো। ফোন করেছিলেন সেই নেতা প্রকৃতির লোকটা।
৫
ফোনে অ্যাডভোকেট সাহেবকে জিজ্ঞাস করছিলেন তার সেই ছোট ভাইয়ের কথা। অ্যাডভোকেট সাহেব বলে দিলেন, "তোমার সেই ছোট ভাইয়ের জন্য তো আজ প্রায় তিন ঘণ্টার মতো সেখানে অপেক্ষা করছিলাম, সে তো আসেনি।" তার উত্তরে সেই লোকটা অবাক হয়ে বললেন, "কি বলেন, উকিল সাহেব? এটা তো অসম্ভব। সে তো সেখানে পৌছানোর পর আমাকে ফোনও করেছিল।"
"তাহলে সে গেল টা কোথায়?"
"আশ্চর্য! আপনার সাথেই তো দেখা করতে গিয়েছিল।"
"আমি বললাম তো, আমি সেখানে ছিলাম প্রায় তিন ঘণ্টার মতো। আমি তো তার কোনো দেখাসাক্ষাৎ পাইনি!"
"আপনি সিওর তো?"
"অবশ্যই! চাইলে আমার কাজের লোককে জিজ্ঞাস করতে পরো। সেও আমার সঙ্গেই ছিল।"
"কি বলেন এসব, উকিল সাহেব? আপনার উপর তো পুরো ভরসা রয়েছে। আমি তো চিন্তিত আছি অন্য বিষয় নিয়ে।"
"তা কি?"
"তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল নাকি! সেটা।"
"সেটা আমার চিন্তার কোনো বিষয় না। এবার কথাটা শেষ হয়ে থাকলে ফোনটা রাখো, এমনিতেই অনেক কাজ পিছিয়ে গিয়েছে এসব নিয়ে।"
"জি, উকিল সাহেব! অবশ্যই।"
এটা বলেই ফোনটা রেখে দিল। অ্যাডভোকেট সাহেব ফোনটা হাত থেকে রেখে, সেই হাত দিয়ে কপাল ধরেছিলেন। উনার ধরনের আন্দাজ দেখে মনে হচ্ছিল, উনার মাথা ধরেছে।
0 Reviews:
Post Your Review