একটি কাজের প্রস্তাবনা - Emperor's Empire
SUBTOTAL :
একটি কাজের প্রস্তাবনা

একটি কাজের প্রস্তাবনা

Short Description:

Product Description

একটি কাজের প্রস্তাবনা 



সেই রাত অ্যাডভোকেট সাহেব খাবারের টেবিলে আমাকে হঠাৎ একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসলেন। উনি জিজ্ঞাস করলেন, "আচ্ছা রাফি, তোমার কাছে ভালমন্দর জ্ঞান কতটুকু আছে?" আমি প্রশ্নটা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলাম, "তেমন একটা নেই। মানে, আপনার তুলনায়। এমনি তো যথেষ্ট জ্ঞান আছে। যতটা সাধারণ মানুষের থাকার কথা, ততটাই আর কি।"
"অর্থাৎ, খুবই সীমিত।"
"জি।"
"আচ্ছা, তুমি কি প্রত্যেক সাধারণ মানুষের জ্ঞানের সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা রাখো?"
"না। সেটা না। কিন্তু সমাজে সাধারণত যা সবাই ভাল বা মন্দ মনে করে থাকে, সে সকল বিষয়বস্তু নিয়ে আমারও একই মত।"
"হুম! তাহলে চলো, তোমার ধারণা আজ পরীক্ষা করা যাক।"
একথা শুনে, কিছুটা ভয় পেয়ে জিজ্ঞাস করলাম, "জি, কেমন পরীক্ষা?"
"আরে, ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। সামান্য কিছু প্রশ্ন করবো।"
"জি, কেমন প্রশ্ন?"
"খুবই সহজ। তুমি শুধু নিজের মতামত জানাবে, আর কিছুই না।"
"ঠিক আছে! বলুন।"
"আচ্ছা, বিড়ি সিগারেট সম্বন্ধে তোমার মতামত কেমন?"
"এ বিষয়ে আমার তেমন একটা মতামত নেই। তবে এতটা জানি; যারা ধূমপান করে, তাদের কাছে এটা বেশ প্রিয়; আর যারা ধূমপান করে না বা ধূমপান পছন্দ করে না, তাদের কাছে এটা ঘৃণিত।"
"হা হা হা! তোমার মতামত বলতে কি চেয়েছি, তা মনে হয় তুমি বুঝতে পারনি। আমি জানতে চেয়েছি, তুমি কি এগুলোকে ভাল মনে কর নাকি মন্দ।"
"যে কাজ মানবজাতির অকল্যাণ বয়ে আনে, তা তো অবশ্যই মন্দ। আমিও বিড়ি সিগারেট সম্বন্ধে একই মত পোষণ করি।"
"তাহলে, সোজাসুজি বলতে গেলে; তুমি এটার ব্যবহারের ফলে যে খারাপ প্রভাব বিস্তার হয়, তার উপর ভিত্তি করে পুরো জিনিসটাই খারাপ বলছো, তাই না?"
"জি!"
"তাহলে, তোমার মতে এর কোনো ধরনের ভাল উপযোগ নেই? কোনো ভাল বা কল্যাণকর উদ্দেশ্যে এটা ব্যবহার করা সম্ভব না?"
আমি কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলাম, "জি না।"
"তবে এবার আমি যদি এটার ভাল একটা ব্যবহার বলতে পারি?"
অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলাম, "এগুলোর ভাল ব্যবহারও আছে?"
"জি! অবশ্যই আছে। তবে সেটা সেবনে নয়, তা রোপণে।"
"ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না।"
"আমি আরেকটু ভাল করে বুঝিয়ে বলি। আসলে, ব্যাপারটা বুঝতে হলে কিছুটা কৃষিবিজ্ঞানের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। আচ্ছা, তুমি কোনো এক শ্রেণীতে কৃষিবিজ্ঞান পাঠ করেছিলে, তাই না?"
"জি, করেছিলাম।"
"তাহলে, নিশ্চয়ই তুমি কীটনাশক শব্দটির সঙ্গে পরিচিত।"
"হ্যাঁ"
"কি সেটা, বলতে পারবে?"
"ফসলের জন্য ক্ষতিকারক সকল পোকামাকড় দমনের জন্য একটি বিষ ব্যবহার হয়ে থাকে। সেই বিষ মাটি বা পানিতে ছিটিয়ে দিলে সকল কীটপতঙ্গ মারা যায়।"



"বাহ্! দারুণভাবে মনে রেখেছ। আচ্ছা, তুমি কি জানতে; সিগারেট দিয়ে এক প্রকার  কীটনাশক বানানো যায়?"
"না। সেটা তো জানতাম না।"
"হা হা হা! তামাক পাতা হলো একটি প্রাকৃতিক কীটনাশক। এটার প্রয়োগের বেলায় আমরা শুধু খারাপ দিকটার দিকেই নজর দিয়ে থাকি। এর ভাল কোনো দিক রয়েছে কি না, তা কখনওই আমাদের চোখে পড়ে না।"
"হুম! বুঝতে পেরেছি।"
"এটার অন্যান্য কিছু উপযোগও রয়েছে। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য তোমাকে কৃষিবিজ্ঞানের জ্ঞান দেয়া নয়। আমার উদ্দেশ্য হলো তোমার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা।"
"কেমন ধরনের পরিবর্তন?"
"বিচারবুদ্ধি এবং বিবেক। একজন মানুষকে কখনওই সাদাকালো তর্কে জড়ানো উচিত নয়।"
"সাদাকালো তর্ক বলতে কি বোঝাতে চাচ্ছেন?"
"সাদাকালো তর্ক বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি; কোনো কিছুকে এত সহজেই ভাল বা খারাপ মনে করে নেওয়া উচিত না। কেননা পৃথিবী হলো রঙিন আর এই রঙিন পৃথিবীর মধ্যেই লুকিয়ে বহু অজানা রহস্য। আচ্ছা, তুমি কখনও রামধনু দেখছ?"
"হ্যাঁ! দেখতে খুবই চমৎকার।"
"হ্যাঁ! কিন্তু তুমি কি জানো, এতে কয়টি রং থেকে থাকে?"
"সাতটি।"
"শাবাস! এবার বলতো দেখি, এই রামধনুর সাতটি রং আমরা কীভাবে দেখতে পাই?"
"বৃষ্টির পর আকাশের এক পাশে দেখতে পাই।"
"কিন্তু তখনই কেন দেখতে পাই? তখন এটা নতুন করে জন্মগ্রহণ করে নাকি তা চিরকাল থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিল?"
"সে প্রশ্ন কখনও মাথায় আসেইনি।"
"সেজন্যই তো। জানতে তো হবে। না জেনে তো থাকলে তো সারাজীবন ভেবেই যাবে, কিন্তু কিছুই করতে পারবে না। শুধু দেখেই যাবে, কিন্তু কিছুই বুঝবে না। শুধু শুনেই যাবে, কিন্তু কিছুই উপলব্ধি করতে পারবে না। জানার একটা ইচ্ছে থাকতে হবে তো।"
"এককালে আমার অনেক জানার ইচ্ছে ছিল। পুরো বিশ্বটার প্রতি আমার কৌতূহল ছিল। তবে তা আর নেই। এখন আমি শুধু কোনোভাবে বাকিটা জীবন শান্তিতে কাটাতে চাই।"
"যেই জীবনকে তুমি শান্তিপূর্ণ মনে করছ, সেই জীবনটা সবচেয়ে বেশি অশান্তির। কেননা, বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হলো জ্ঞান। একজন মানুষের মধ্যে সেই জ্ঞান নামক জিনিসটা না থাকলে, তার অস্তিত্বের কোনো মূল্য আর থাকে না। সে হয়ে পড়ে একটা জীবন্ত লাশ।"



"কিন্তু পৃথিবীতে এমন অনেকেই তো আছে, যারা কিছু না জেনেও বেঁচে আছে। তাদের অস্তিত্বও কি বৃথা?"
"অবশ্যই। কারণ তারা বেঁচে আছে শুধু বাহ্যিক দিক দিয়ে। বাস্তবে তাদের কোনো পরিচয় নেই, কোনো পৃথক গুণাবলি নেই, নেই কোনো প্রতিভা, নেই কোনো বিশ্বাস। মোট কথা বলতে গেলে, তাদের কাছে বেঁচে থাকার কোনো কারণই নেই। এদের মৃত্যুতে মর্মাহত হবার কেউ নেই। এদের মনে রাখার মতো কোনো স্মৃতি নেই। এই সামান্য একটা শ্বাসপ্রশ্বাসের কার্যক্রমকে যদি তুমি জীবন বলে থাকো, তাহলে তোমার বেঁচে থাকার সংজ্ঞাটি ভুল। কিন্তু কথা অন্য হচ্ছিল ভিন্ন প্রসঙ্গে। কি ছিল সেটা?"
"আপনি রামধনুর রং নিয়ে কিছু বলছিলেন।"
"ওঃ হ্যাঁ! ধন্যবাদ। আমি বলছিলাম, রামধনুর সাতটি রং আমরা শুধু বৃষ্টির পরই দেখতে পাই। তার একটা নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। সেই কারণটা হলো; এই সাতটি রং সর্বদা লুকিয়ে থাকে সূর্যের সাদা রশ্মির মধ্যেই। সেই রশ্মি খালি চোখে দেখতে গেলে শুধু সাদা, কিন্তু বৃষ্টির পরে তার মধ্যের যত রং আছে, তা দেখতে পাওয়া যায়। এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় যাব না, তবে এতে প্রমাণিত হয় যে সাদাও পুরোপুরি সাদা নয়।"
"কিন্তু কালো তো কালোই হয়, তাই না?"
"না! কালোর মধ্যেও অসংখ্য প্যাঁচ রয়েছে।"
"কেমন প্যাঁচ?"
"কালো হলো আধারের রং। এই আধারেই লুকিয়ে থাকে মানুষের মনের এবং প্রাণের নানা রহস্য। তাছাড়া বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলেও আমরা দেখতে পাই; কালো একটিমাত্র রং হবার সত্ত্বেও এর সৃষ্টির মোট চারটি ভিন্ন পন্থা আছে। মোট সাতটি রঙের চার ভিন্ন ধরনের মিশ্রণের মাধ্যমে কালো রং তৈরি করা সম্ভব।"
"শেষের ব্যাখ্যাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।"
"সোজাসুজি বলতে গেলে; সাতটি রঙের এমন চারটি মিশ্রণ আছে, যার ফলে কালো উৎপাদন করা যায়। যেমন: সবুজ এবং লালের সংমিশ্রণে কালো তৈরি করা সম্ভব। ইত্তেফাক  দেখো, আমাদের দেশের পতাকাটাও লাল আর সবুজ। কি অদ্ভুত একটা ব্যাপার না?"
"জি! আসলেই।"



"আচ্ছা, তুমি নিশ্চয়ই চিন্তা করছ যে আমি তোমাকে এতগুলো প্রশ্ন জিজ্ঞাস করছি, এতগুলো ব্যাখ্যা দিচ্ছি, নিজের মানসিক বিকাশ ঘটানোর কথা বলছি; এসবের পেছনে নিশ্চয়ই আমার কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে, তাই না?"
আমি কিছুটা ঘাবড়ে উত্তর দিলাম, "না! তেমন কিছু না।"
"ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আমি একটা বিশেষ উদ্দেশ্যেই এই প্রশ্নগুলো করেছি।"
"সেই উদ্দেশ্যটা কি?"
"সেটা বলার আগে আরো কিছু প্রশ্ন করার ছিল একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে।"
"জি, বলুন।"
"তুমি আজ কি কি দেখেছিলে এবং কি কি শুনেছিলে? তার সবটুকু আমাকে বলো।"
একথা শুনে আমি থতমত খেয়ে, একটু নিম্ন স্বরে জিজ্ঞাস করলাম, "কি দেখাশোনার কথা বলছেন? আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।"
মুচকি হেসে বললেন, "আরে মিঞা, ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। আমি ভাল করেই জানি, তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের কথাগুলো শুনছিলে।"
"তা কি করে বুঝলেন?"
"তোমার কি মনে হয়, আমি এতই বোকা? আমি এত কোটি কোটি টাকা কামাই করি, এত বড় একটা বাসার মালিক, এত ধনী হবার সত্ত্বেও বাসায় গুপ্ত ক্যামেরার ব্যবস্থাও করতে পারবো না?"
"তা অবশ্যই পারবেন। আপনার তো যথেষ্ট সামর্থ্য আছে। কিন্তু আমি তো কখনও কোনো ক্যামেরা দেখিনি।"
"ক্যামেরাগুলো খুবই অস্বাভাবিক স্থানে অবস্থিত। সেগুলোর অবস্থান শুধু আমিই জানি। তোমার আগে জিনি কাজ করতেন, উনিও এ সম্বন্ধে কিছু জানতেন না।"
"এসব আমাকেই বলছেন। এতই বেশি বিশ্বাস আমার উপর?"
"তা তো অবশ্যই। কেননা তোমার মধ্যে জানার আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও, তা তুমি লুকিয়ে রাখো। এমন মন মানসিকতা সবাই পোষণ করতে পারে না। সেক্ষেত্রে তুমি বাকি সবার তুলনায় আমার কাছে ব্যতিক্রম একজন ব্যক্তি। আমি চাই তুমি যাতে এতটাই জানো যে তোমার জ্ঞান খুব তাড়াতাড়িই চরম মাত্রায় বিকশিত হোক।"
আমি খুবই অবাক হলাম উনার এই কথাগুলো শুনে। মনে মনে ভাবছিলাম, এর পিছনেও নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। তবে অতিমাত্রার ভয়ের কারণে তা জিজ্ঞাস করতে দ্বিধা বোধ করছিলাম। ইতিমধ্যে অ্যাডভোকেট সাহেব নিজের থেকেই বলে উঠলেন, "তোমার নীরবতার কারণ আমি ভাল করেই জানি। আমি তোমাকে আশ্বাস দিচ্ছি, তোমার চিন্তিত হবার কিছুই নেই। তোমার কোনো প্রকার ক্ষতিসাধন করার কোনো উদ্দেশ্য নেই আমার। উদ্দেশ্য আছে তো শুধু তোমাকে একজন স্বনামধন্য মানুষে পরিণত করা এবং সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে, এই সমাজের এক সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে জীবনযাপন করার সুযোগ করে দেয়া।"



"কিন্তু হঠাৎ আমার প্রতি এত দরদ! তার তো নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে, তাই না?"
"ঠিক! তবে যে কারণে আমি তোমার জন্য এসব করবো তা হলো আমার প্রতি তোমার আনুগত্য। আমার সকল কাজেই তোমার যথাযথ সহায়তা এবং সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা আশা করার মতো নির্ভরযোগ্যতাই আমার জন্য যথেষ্ট হবে।"
"কি ধরনের কাজ?"
"সেটা তো তুমি ভাল করেই জানো। আমাকে নতুন করে কিছু বোঝানোর কোনো প্রয়োজন নেই। আমি জানি, তুমি যথাযথ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী, তাই তোমাকেই বিশ্বাসযোগ্য কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত মোটেও ব্যর্থ হবে না।"
"কিন্তু আমি তো এমনিতেই আপনার জন্য কাজ করি। আলাদাভাবে করে আর কি কি করাতে চাচ্ছেন আমার মাধ্যমে?"
"গোয়েন্দাদের মতো কিছু তদন্তের কাজ। ব্যাস! আর কিছু না।"
"কিন্তু আমি তো কোনো গোয়েন্দা না। আমি তো কখনও এমন ধরনের কাজ করিওনি।"
"মানা না করে, নিজের যোগ্যতার অজুহাত দিচ্ছো। অর্থাৎ আগ্রহ রয়েছে ঠিকই, ঘাবড়ে গিয়েছ। ধরা খাওয়ার ভয়, তাই তো?"
"জি!"
"সেটা কোনো ব্যাপার না। অভিজ্ঞ ব্যক্তি লাগলে তোমায় বলতাম না। আমার দরকার এমন কারো, যে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখাশোনার কাজ করতে পারবে। ঠিক সেভাবেই, যেভাবে তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের দেখছিলে এবং আমাদের কথাগুলো শুনছিলে।"
"সেটা তো ছোটখাটো ব্যাপার ছিল। আমি তো আপনার কাছে ধরাও পড়লাম।"
"তা তো পড়েছো, কিন্তু তা নিজের কোনো ত্রুটির কারণে নয়। তুমি ধরা পড়েছো একমাত্র আমার সতর্কতার কারণে। এই সতর্কতা সকলের মধ্যে বিদ্যমান নয়। বরং অবহেলাটাই বেশি। তাই তুমি এই কাজের জন্য পুরোপুরি যোগ্য এবং দক্ষ একজন প্রতিনিধি।"
"আমি যদি কোনো ভুলে ভুলে কোনো প্রকার ভুল তথ্য নিয়ে আসি? তাহলে তো তার দায়ভার আমাকেই নিতে হবে।"
"আমি তো এখন পর্যন্ত একবারও দায়ভারের কথা বলিনি। আমি তো শুধু কাজ এবং তার পুরস্কারের কথা বলেছি। তোমার দায়ভার নেয়ার কোনো দরকার নেই। তুমি শুধু তথ্য আদানপ্রদান করবে, আর কিছুই না।"
অ্যাডভোকেট সাহেবের মুখ থেকে একথা শুনে আমার মনের সব ভয়ভীতি দূর হয়ে গেল, আর আমি আনন্দে মেতে উঠে, খুবই আগ্রহের সঙ্গে, মুখে বড় একটা হাসির সঙ্গে বললাম, "ঠিক আছে! ঠিক আছে! তাহলে আমি রাজি। এবার বলুন, কি করতে হবে আমার?"
আমার আগ্রহ দেখে অ্যাডভোকেট সাহেব হেসে বললেন, "হা হা হা! দ্যাট্স দা স্পিরিট, মাই বয়! এবার গিয়ে লাইনে এসেছ। তোমাকে তোমার কাজ বোঝানোর আগে আমাকে জানতে হবে তুমি কতটা দেখেছো, আর কতটা শুনেছো।"
"আমি আপনাদের আলাপের অধিকাংশটুকুই শুনেছি। বলতে গেলে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্তই। তবে ঠিক যে সময়ে কথা শুরু হয়েছিল, ঠিক সেই সময়ের কথাটুকু শুনতে পারিনি।"
"তার স্বামীর ব্যাপারটা শুনেছো তো?"
"হ্যাঁ! উনার কাছ থেকে ম্যাডাম তালাক চান।"
"একদম ঠিক! তার পরের ভাগ মনে আছে?"
"আপনি তালাক আদায় করে নেয়ার একটা পন্থা বলেছিলেন। কারো সঙ্গে যদি হাতেনাতে ধরা খেয়ে যায়, তাই তো?"
"হ্যাঁ! তার জন্য একজন গুপ্তচর নিয়োগ দেয়ার কথা মনে আছে?"
"জি! আপনার পরিচিত কারো কথা বলছিলেন।"
"হ্যাঁ! সেই পরিচিত গুপ্তচরটাই তুমি।"
আমি উনার এই কথাটা শুনে প্রথমে অবাক হলেও, তা বলার আগেই কিছুটা ধারণা করতে পেরেছিলাম। একথা মাথায় রেখে, খুবই শান্তশিষ্টভাবে বললাম, "উক্ত কাজটি করবার পূর্বে, আমার কিছু প্রশ্ন ছিল। আপনার অনুমতি হলে, তা জিজ্ঞাস করবো।"
"তোমার প্রশ্নের উত্তর না দিলে কি কাজটা করবে না?"



"আমি সেটা বলিনি। আমি শুধু নিজের মনের একটা কৌতূহল প্রশ্ন করার অনুমতি চাচ্ছিলাম। তবে আপনি জবাব দিতে অনিচ্ছুক হলে, আমি আর প্রশ্ন করবো না।"
"হা হা হা! আমি তো ঠাট্টা করছিলাম। বলো! বলো! কি প্রশ্ন তোমার?"
"জি, আমার প্রশ্ন হচ্ছে; আপনি তো বলেছিলেন আপনার একটাই প্রেমিকা আপনাকে ছেড়ে দিয়েছিল সেই দুর্ঘটনার পর। তখন তো আপনি নতুন কোনো সঙ্গীর কথা উল্লেখও করেননি। তাহলে এই ম্যাডামটা কে? উনার সঙ্গে কিভাবে প্রেম আর বিয়ের কথা শুরু হলো?"
"বৃষ্টির সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল মারজিয়ারও আগ থেকে। সে আমার খুবই ভাল একজন বান্ধবী ছিল। তার আর আমার মধ্যে কখনও এই আকর্ষণ ছিলই না। আসলে, আমার মতে তা ছিল না, কিন্তু তার মনে আমার জন্য জায়গা করাই ছিল।"
"প্রেমটা কীভাবে হয়েছিল?"
"তোমার মনে আছে, যখন মারজিয়া আমাকে ফোনে উল্টাপাল্টা শুনিয়েছিল? সেসময় বৃষ্টি আমার খাতির তার বাসায় গিয়ে, তাকে মানানোর চেষ্টা করে, সে না মানাতে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, সারা দিনরাত হাসপাতালে আমার সেবা করে, রাত জেগে থাকত আমার জন্য, আমার ঔষধের নিয়মানুবর্তিতার খেয়াল রাখত। আমার জন্য তার পরিবারের কাছেও অনেক বকাঝকা শুনতে হয়। তবুও সে আমার পাশেই ছিল। একদিন জিজ্ঞাস করে বসলাম; আমার এত খেয়াল রাখার বিনিময়ে তাকে আমি কীভাবে ধন্যবাদ জানাতে পারি। তখন সে তার গালের টোল পড়া মিষ্টি হাসি দিয়ে আমাকে বলে, সে আমার ভালবাসা ছাড়া আর কিছুই চায় না। আর এভাবেই কিছু মাসের শ্রম এবং সেই একটি মুহূর্তের জাদুর ছোঁয়ায়, আমি তার প্রেমে মাতাল হয়ে পড়লাম।"
"যে আপনার জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করেছিল, তার জন্য আপনি তার বাবার কিছু মন্দ আচরণ সহ্য করতে পারলেন না? কাউকে মন থেকে ভালবেসে থাকলে অন্তত এতটুকু ধৈর্য তো থাকা দরকার।"
একটু বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, "তুমি তোমার প্রশ্নের উত্তর চেয়েছিলে, যা আমি দিয়েছি। আমি এই প্রসঙ্গে তো তোমার মতামত জানতে চাইনি। তাছাড়া তোমার এই উক্তিটি আমার কাছে পুরোপুরি অযৌক্তিক।"
"অপ্রয়োজনীয় মতামতের জন্য দুঃখিত। কিন্তু আমার উক্তিটি অযৌক্তিক হওয়ার কারণ জানতে পারি?"
"ভালবাসা সম্পর্কে তোমার ধারণাই তো অযৌক্তিক। এই ভ্রান্ত ধারণা সম্পর্কে কি বলতে পারি, বলো?"
"তাহলে আমার জ্ঞান বিকশিত করার উদ্দেশ্যে হলেও, আমাকে ভালবাসার সঠিক ধারণাটা দিন। আমার এ সম্বন্ধে অধিক আগ্রহ রয়েছে।"


"দেখো, ভালবাসা শুধু স্বীকারকেই বোঝায় না। ভালবাসা হলো একটি মনে, আরেকজনের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান এবং আত্মিক বন্ধন। ভালবাসায় কখনও দেখা হয় না, কে কত সুন্দর বা, কে কত কুৎসিত। কারণ যদি দেখার ভিত্তিতে হয়েছে, তা হলো চোখের পছন্দ। ভালবাসা কখনও কণ্ঠ শুনে হয় না। কারণ সুন্দর কণ্ঠস্বর শুধু কানের পছন্দ। ভালবাসা কখনও শারীরিক চাহিদার জন্য হয় না। কারণ সেই চাহিদা মেটানোর আরো অনেক উপায় রয়েছে। ভালবাসা কখনও আগ্রহের মাধ্যমে হয় না। ভালবাসা কখনও সম্পদ দেখে হয় না। কারণ সেটা হলো লোভ। ভালবাসা কখনও দয়া করে হয় না। কারণ সেটা হলো ভিক্ষা। কারণ আগ্রহ তো সবার প্রতিদিন পরিবর্তিত হয়ে থাকে।" এরপর হঠাৎ মাটির দিকে চেয়ে, কোনো এক চিন্তায় হারিয়ে উনি গেলেন।
"জি, কিছু ভাবছেন?"
অ্যাডভোকেট সাহেব চমকে উঠে বললেন, "না! তেমন কিছু না। তো, আমি যা বলছিলাম। ভালবাসা এতটাই সহজলভ্য নয়। যদি তা ই হতো, তাহলে তো আর কোনো সমস্যাই হতো না। ভালবাসা মানে এই না, যে সারাদিন একে অপরের জন্য শুধু দিয়েই যেতে হবে। কোনো কোনো সময় কষ্ট দেওয়াও ভালবাসার এক বহিপ্রর্কাশ। কখনও কখনও ঝগড়া করাও ভালবাসার একটি ছোটখাটো রূপ। কখনও কখনও ভুলে যাওয়াটাও ভালবাসার অনেক বড় একটা প্রতিচ্ছবি।"
"কিন্তু যাকে ভালবাসি, তাকে কষ্ট দিব কি করে? যাকে ভালবাসি, তার সঙ্গে ঝগড়া হবেই বা কেন? যাকে ভালবাসি, তাকে কি ভুলে যাওয়ার জন্য একসময় ভালবেসেছিলাম?"




"কেন? কেন কষ্ট দিতে পারবে না? তাকে কষ্ট দিয়ে যদি সঠিক কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যায়, তবে কেন কষ্ট দিতে পারবে না? যদি কোনো বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করার ফলে ঝগড়া লেগে যায়, তবে কি সেই ঝগড়ার দ্বারা উভয়ের মানসিকতা সম্বন্ধে আরো ভাল ধারণা পাওয়া সম্ভব না? তুমি যদি কখনও ঝগড়া না ই করে থাকো, তবে তো তুমি বিভিন্ন প্রসঙ্গে তার মতামত জানতে পারবে না। ফলে তাকে কখনও পুরোপুরি বুঝতে পারবে না। আর যদি ভুলে যাওয়ার কথা বলি, সেক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রথমে নিজের বিবেকের দিকে তাকাতে হবে। তুমি কাউকে একতরফা ভালবেসে থাকলে, তার কাছ থেকে কখনও ভালবাসা আশা করা যায় না। কারণ তা ভালবাসা হবার সত্ত্বেও শুধুমাত্র ব্যক্তিগত একটা ব্যাপার। সে যদি তোমাকে ভাল না বেসে থাকে, তবে নিশ্চয়ই অন্য কাউকে তো ভালবাসবে। সেই মুহুর্তে তোমার জন্য সর্বোত্তম করণীয় হলো, তাকে মন থেকে ভুলে যাওয়া। কারণ যতদিন সে তোমার মনে থাকবে, ততদিন সে তোমার জীবনে থাকবে না। যার ফলে সৃষ্টি হবে ঘৃণা এবং ক্রোধ। এককালে যাকে ভালবাসতে, তার প্রতি মনে শুধু নেতিবাচক চিন্তাচেতনা রয়ে যাবে। তাই ভুলে যাওয়াও একজন আদর্শ প্রেমিকের প্রশংসনীয় একটি গুণ। এই নাও। তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। আরো কোনো প্রশ্ন থাকলে বলতে পারো।"
"না! আর কোনো প্রশ্ন নেই। তবে একটা বিষয়ে আপনার মতামত চাই।"
"হ্যাঁ, বলো।"
"ভালবাসা তো রূপ দেখে হয় না। তবে এমন কেউ যদি থাকে, যে সমাজের কাছে কুৎসিত হয়ে থাকলেও আমার কাছে সবচেয়ে রূপবতী? অর্থাৎ শুধু আমার কাছেই সে সুন্দর। তবে সেটাও কি রূপ দেখে পছন্দ করার মতোই হবে?"
"হ্যাঁ, অবশ্যই। কেননা একজন ব্যক্তিকে ভালবাসার জন্য তার সুন্দর হবার এমন কি প্রয়োজন? তুমি যদি একজনের কুৎসিত হওয়া মেনে নিয়ে, তার সঙ্গে জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখতে পারো; তুমি ভালবেসেছো। তুমি যদি তার অস্তিত্বকে সেই সম্মানটুকু দিতে পারো, যেটা অন্য যেকোনো সুন্দর ব্যক্তিকে দিতে পারো; তুমি ভালবেসেছো। তুমি যদি সেই কুৎসিত ব্যক্তির পাশে থেকেই মনের তৃপ্তি পাও, যে তৃপ্তি কোনো সুন্দর ব্যক্তির পাশে থেকেও না পেয়ে থাকো; তুমি ভালবেসেছো। মোট কথা হচ্ছে; সত্যকে ভালবাসো তা পুরোপুরি মেনে নিয়ে। সেই সত্যের মধ্যে যদি মিথ্যার দাগ পাওয়া যায়। তবে সেই একটা দাগের জন্য সত্যটা কলঙ্কিত সতে পারে, কিন্তু পরিবর্তিত হতে পারে না।"
"হুম! বুঝতে পেরেছি। এবার আমার ধারণা অনেকটা পরিষ্কার হয়েছে।"
"ঠিক আছে! আজকের আলোচনা এখানেই সমাপ্ত করছি। তোমার কাজ কাল সকালে বুঝিয়ে দিব।"
"ঠিক আছে!"




"ওঃ, আরেকটা কথা। আজ রাতে আমার রুমের আশেপাশে যাতে না দেখি। দরকার পড়লে একটা জগের মধ্যে পানি নিয়ে, নিজের রুমে রেখে দাও।"
"ঠিক আছে!" বলেই আমি সকল থালাবাসন ধুয়ে, এক জগ পানি নিয়ে, ঘুমোতে চলে গেলাম। বিছানায় শুয়ে শুয়ে, খোলা চোখে এক মধুর স্বপ্ন দেখছিলাম। ছোট থেকেই স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে, প্রতিষ্ঠিত হয়ে, এক সুন্দরী দেখে মেয়ে বিয়ে করবো। মা বলতেন, তার জন্য অনেক বড় কপাল লাগে। বাবা বলতেন, তার জন্য প্রচুর টাকাপয়সা লাগে। শিক্ষকেরা বলতেন, তার জন্য অধিক শিক্ষিত হতে লাগে। কি বিশাল কপাল আমার! অ্যাডভোকেট সাহেবের জন্য কাজ করছি, উনার কাজগুলোর জন্য টাকাপয়সাও প্রচুর পাবো, তাছাড়া আমাকে নানান বিষয়ে শিক্ষাও প্রদান করা হচ্ছে। অর্থাৎ এখন আমার কাছে একজন সুন্দরী নারী বিয়ে করার মতো সামর্থ্য রয়েছে। তবে এবার আমার আর সেই উদ্দেশ্য নেই। এবার আমার স্বপ্ন একজন এমন কাউকে বিয়ে করা, যে আমাকে প্রকৃতপক্ষে ভালবাসবে। সে হোক সুন্দর, হোক কুৎসিত; সে হবে শুধু আমার, আমি তাহার। এই স্বপ্নটা চোখে রেখে, চোখটা সামান্য বন্ধ করলাম। চোখ বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে মুখে একটি মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল। সেই রাত চোখ দুটো খোলার মতো ইচ্ছে করছিল না। ইচ্ছে করছিল এই সুন্দর স্বপ্নেই ডুবে থাকি। এমনই এক শান্তিপূর্ণ মুহূর্তে শুয়ে ছিলাম। তার ইতিমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

0 Reviews:

Post Your Review